সারা দেশের দৃষ্টি আজ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের ঘোষণাপত্রে কী থাকছে। ছাত্রনেতারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি, মর্যাদা, সাম্য, ন্যায় ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠায় চার দফার মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র তুলে ধরা হবে। বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে জুলাইয়ে শহীদ, আহত যোদ্ধা এবং সর্বস্তরের নাগরিককে নিয়ে লিখিত এই বিপ্লবী বার্তা ঘোষিত হবে। ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দুই হাজার শহীদ পরিবার, ২৫ হাজার পঙ্গু বীরদের চাহিদা অনুযায়ী দেশ বিদেশের বিশেষজ্ঞ কূটনৈতিকদের নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ঘোষণাপত্রে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠায় বিগত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতিবাচক প্রভাব ও আওয়ামী লীগ যুগের ফিরিস্তি তুলে ধরা হবে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য চারটি দফার মধ্যে রয়েছে, (১) শেখ হাসিনার শাসনাধীন সব সংসদ সদস্য এবং উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিলুপ্তি ঘোষণা। (২) ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি থাকবে ছাত্র-জনতার সমর্থন। (৩) ৭২ সালের সংবিধান সংস্কার বা বাতিল হবে (৪) এটি হবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সংবিধানের পুনর্গঠন। একই সঙ্গে উপস্থিত ছাত্র-জনতা এই চার দফা প্রতিষ্ঠায় শপথ গ্রহণ করবেন। যাতে আর কখনো রাজনৈতিক দলের নির্দেশে ২০২৪ সালের মতো শত সহস্র পিতা-মাতাকে সন্তানহারা হতে না হয়। স্ত্রীদের বিধবা হতে না হয়। রাজনৈতিক স্বার্থে গুলিতে পঙ্গু জীবন কাটাতে না হয়। দেশের মানুষের নিরাপত্তা সুরক্ষায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন জনকণ্ঠকে বলেন, সারা বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ও সাধারণ মানুষ ঢাকায় আসছেন। হাসিনা সরকারের পতনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক দফা ঘোষণার দিন যত মানুষ হয়েছেন তার চাইতে বেশি মানুষ আজ মঙ্গলবার শহীদ মিনারে আসবেন। জাতীয় পার্টি ছাড়া দেশের সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যারা জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধা তাদের মাধ্যমে ঘোষণাপত্রটি উপস্থাপন করা হবে। মঞ্চে শহীদ এবং আহত ব্যক্তিরা অগ্রভাগে থাকবেন। বিশস্ত সূত্রে জানা যায়, ঘোষণাপত্রে যে বিষয়গুলো পাঠ হবে তাতে থাকবে- এই ভূমির মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে।
যেহেতু, পাকিস্তান এই ভূমির মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে এবং লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, এই ভূমির মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে গৌরবময় ’৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ’৭২ সালের সংবিধান লাখ লাখ শহীদের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্র ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার পথ প্রশস্ত করেছে। সামরিক আইন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনী রাষ্ট্রকে দুর্বল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে অরক্ষিত করেছে। এই অশান্ত যাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের যন্ত্র হিসেবে ব্যর্থতা কুখ্যাত ১/১১ বন্দোবস্ত করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে এক-এগারো নীতিমালা বাংলাদেশে মুজিববাদী ধারা স্থায়ী করেছে এবং শেখ হাসিনার প্রশ্নাতীত ক্ষমতা এবং আধিপত্যের পথ সুগম করেছে। লিখিত ঘোষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হবে, উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও প্রতিশ্রুতিগুলো ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের পূজার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সামরিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন রাজনীতিকরণ, দুর্নীতি এবং পঙ্গুত্বের শিকার হয়ে দমনমূলক ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আরও দাবি তোলা হবে- গত ১৫ বছর ধরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং ভিন্নমত দমন করা হয়েছে। পিলখানা, শাপলা হত্যাকা- এবং প্রহসনের বিচারিক হত্যাকা- রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সংঘটিত হয়েছে। সংখ্যালঘু এবং নারী গোষ্ঠীগুলো ফ্যাসিস্ট শাসনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের জন্য কোনো বিচার করা হয়নি। যেহেতু, ভারতবিরোধী সক্রিয়দের বাংলাদেশপন্থি অবস্থানের জন্য নির্মম নির্যাতন, গুম এবং হ’ত্যা করা হয়েছে। বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ঘোষণাপত্রে আরও উল্লেখ থাকছে, শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য হত্যা এবং অবিচারের শিকার হয়েছে।
রাষ্ট্রসমর্থিত পুঁজিবাদ এবং উন্নয়ন প্রকল্প পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিস্থিতি খারাপ করেছে। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং সরকারি কর্মকর্তারা শেখ পরিবার এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মিলে রাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। পরপর তিনটি নির্বাচন অবৈধ এবং দুর্নীতিপূর্ণভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং জনগণ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষার্থী এবং যুবসমাজ ক্যাম্পাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং সরকারী চাকরি আওয়ামী লীগের পার্টি উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। এতে জুলাই বিপ্লবের কথাও তুলে ধরা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে এবং শেখ হাসিনার ‘রাজাকারদের নাতি’ মন্তব্য তাদের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে এবং নারী শিক্ষার্থীদের ওপর বিশেষভাবে সহিংসতা চালানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ফ্যাসিস্ট অপরাধীরা হাজার হাজার নিরস্ত্র শিক্ষার্থীকে হ’ত্যা করেছে। শিক্ষার্থীরা নয় দফা দাবি পেশ করায় হাসিনা সরকার গু’লি করে কুপিয়ে ছাত্র-জনতাকে হ’ত্যা করেছে।
জুলাইয়ের ঘটনাবলিতে উপস্থাপন হচ্ছে, সরকার শিক্ষার্থীদের এবং সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ এবং ব্লক রেইড জারি করেছে। শিক্ষার্থীরা অনির্বাচিত এবং অবৈধ শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে এবং এই অহিংস আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, সকল ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মানুষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং এমনকি সেনাবাহিনী কর্মকর্তারাও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা, সর্বজনীন সমর্থন পেয়েছে এবং এভাবে হাজারেরও বেশি আত্মত্যাগ করেছে। আজ থেকে আমরা নিজেদের স্বাধীন জনগণ হিসেবে ঘোষণা করছি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে ‘কমরেডস, ৩১ ডিসেম্বর! এখন না হলে কখনোই নয়। ‘থার্টিফার্স্ট ডিসেম্বর, নাও অর নেভার’, ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন’-এমন স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর অন্তত অর্ধডজন বিশ্বস্ত ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা হয় জনকণ্ঠের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ’৭২-এর সংবিধানে ভারতের ইচ্ছের প্রতিফলন ছিল। তাদের সংবিধানের রিপ্লেসমেন্ট, ভারতীয় আধিপত্যাবাদের রিপ্লেসমেন্ট। এ জন্য ভারত বাংলাদেশের উপর চেপে বসে আছে। হাসিনার রাজনীতি ’৭২-এর সংবিধানের উপর। ’৭২-এর সংবিধানকে পুঁজি করে হাসিনা এ দেশের মানুষকে অতীতেও হত্যা করেছে চব্বিশে দুই হাজার মানুষকে খুন করেছে। হাসিনার ফ্যাসিজম ’৭২-এর সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েই ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন শহীদ হয়েছেন। আমাদের কথা স্পষ্ট, মুজিববাদী সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান লিখতে হবে। আর যারা ’৭২-এর সংবিধান রাখতে চাইবেন তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা হবে। আজ শহীদ মিনার থেকে থেকে চব্বিশের বিপ্লব এবং বিজয় রক্ষায় জাতিকে বার্তা দেওয়া হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহিন সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘৭২-এর সংবিধানে আওয়ামী ফ্যাসিস্টের সব উপকরণ রয়েছে। এই সংবিধান রেখে কোনোভাবেই দুই হাজার শহীদ পরিবারের রক্তের বিজয় রক্ষা হবে না। প্রায় ২৫ হাজার আহত যোদ্ধা যাদের ত্যাগে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না। এই শহীদ পরিবার, আহত যোদ্ধারা কেউ মুজিববাদী সংবিধান চায় না। আমরাও যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত রয়েছি তারা কেউ এই মুজিববাদী সংবিধান চাই না। আজকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তা সুরক্ষা এবং স্বপ্ন পূরনে নতুন যাত্রা শুরু হবে। রবিবার এক ব্রিফিংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ জানান, ৩১ তারিখ মুজিববাদী বাংলাদেশ সংবিধানের কবর রচনা হবে। আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করা হবে।