
আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেন শপথ নেবেন কি না বা শপথ নিলে তিনি কতদিন দায়িত্ব পালন করবেন তা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান আইন অনুযায়ী এই সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের মেয়াদ আছে আর মাত্র এক মাস। যদি নতুন করে তফসিল ঘোষণা করা হয়, সেখানে যদি ইশরাক হোসেন প্রার্থী হতে চান তাহলে তাকে এই সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।
আবার এটাও বলা হচ্ছে, মেয়র নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। এখন কেন তিনি এক মাস দায়িত্ব পালন করবেন। বিষয়টা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করলে ঝুলে যাবে।
ইশরাকের দল বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দলীয়ভাবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হলে জানানো হবে।
তবে ইশরাক হোসেন বলছেন, কতদিন দায়িত্ব পালন করবো তা স্থানীয় সরকার আইনে বলা আছে। আমি মনে করি, আমি পাঁচ বছরের জন্যই নির্বাচিত হয়েছি।
স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে শপথ নিতে এখনো কোনো দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্টরাও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মন্তব্য করছেন না।
শপথ নিলে ইশরাক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এক মাস!
জানা যায়, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস বিজয়ী হন। পরে এ সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে ২০২০ সালের ৩ মার্চ তাপস, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ আটজনকে বিবাদী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন। এর পাঁচ বছর পর গত ২৭ মার্চ ওই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল।
ইসি সূত্র জানায়, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ডিএসসিসির মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে সেটাই প্রমাণ হয়েছে। গত রোববার (২৭ এপ্রিল) বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে ইসি। কিন্তু নির্বাচনের পাঁচ বছর পর ইশরাকের দায়িত্ব গ্রহণ এবং মেয়াদকাল কতদিন হবে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এতদিন পর ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করায় নাগরিকদের মনে এক প্রকার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের প্রশ্ন এখন যদি ইশরাক মেয়র পদে বসেন এবং ক্ষমতা ছাড়তে না চান তখন একটা জটিলতা তৈরি হবে। কারণ, মেয়র নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। এখন কেন তিনি এক মাস দায়িত্ব পালন করবেন।- ড. আদিল মুহাম্মদ খান
নির্বাচনের সাড়ে চার মাস পর (১৬ মে, ২০২০) শেখ ফজলে নূর তাপস ডিএসসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেন। ২০২০ সালের ২ জুন করপোরেশনের সব কাউন্সিলরকে নিয়ে প্রথম বোর্ড সভা করেন শেখ তাপস। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ অনুযায়ী, মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বোর্ড সভা থেকে তার মেয়াদকাল শুরু হয়। অর্থাৎ, নতুন মেয়র যেদিন কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রথম সভা করেন, সেদিন থেকেই শুরু হয় তার পাঁচ বছরের মেয়াদকাল।
হিসাব অনুযায়ী, আগামী ১ জুন পর্যন্ত শেখ তাপস মেয়রের দায়িত্বে থাকার কথা ছিল। যদিও ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট গোপনে দেশ ছেড়ে পালান তিনি। আবার ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিএসসিসির আওয়ামীপন্থি সব কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে যান। পরে ১৯ আগস্ট শেখ তাপসসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সরকার ডিএসসিসিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়।
গেজেটের কপি মন্ত্রণালয়ে
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে ইসির গেজেটের কপি সোমবার (২৮ এপ্রিল) মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী ইশরাক হোসেনকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দিনক্ষণ নির্ধারণ করলে ওই দিন থেকেই ইশরাক হোসেন মেয়রের চেয়ারে বসতে পারবেন।
কিন্তু তিনি ঠিক কতদিন দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিয়ে ইসি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে। তবে প্রাথমিকভাবে শেখ তাপসের প্রথম বোর্ড সভাকে বৈধতা ধরে আগামী ১ জুন পর্যন্ত ইশরাক হোসেন মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে ইসি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একমত হয়েছে। পরে ইসির করণীয় কী হবে, তা আগামী মে মাসের মধ্যেই ঠিক করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সিটি করপোরেশন-১) মাহবুবা আইরিন বলেন, ‘ইশরাক হোসেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমরা কাজ করছি। নিয়ম অনুযায়ী গেজেট প্রকাশের পর এক মাসের মধ্যে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান করতে হয়। আশাকরি এ সময়ের মধ্যে আমরা তা করতে সক্ষম হবো।’
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
দেশের নগর, অঞ্চল ও গ্রামীণ পরিকল্পনাবিদদের জাতীয় পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এতদিন পর ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করায় নাগরিকদের মনে এক প্রকার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের প্রশ্ন এখন যদি ইশরাক মেয়র পদে বসেন এবং ক্ষমতা ছাড়তে না চান তখন একটা জটিলতা তৈরি হবে। কারণ, মেয়র নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। এখন কেন তিনি এক মাস দায়িত্ব পালন করবেন।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করলে ঝুলে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে নগরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও অন্য সেবামূলক কাজ করা কঠিন। এর বড় কারণ, এখন তো করপোরেশনে কোনো কাউন্সিলরই নেই। তাই ইসির উচিত ছিল এসব জটিলতা তৈরি না করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া।’
বর্তমান আইন অনুযায়ী এই সিটি করপোরেশনের মেয়াদ আছে আর ১৫-১৬ দিন। সেই অনুযায়ী যদি নতুন করে তফসিল ঘোষণা করা হয়, সেখানে যদি ইশরাক হোসেন প্রার্থী হতে চান তাহলে তাকে এই সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।- স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান আইন অনুযায়ী এই সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের মেয়াদ আছে আর মাত্র এক মাস। সেই অনুযায়ী যদি নতুন করে তফসিল ঘোষণা করা হয়, সেখানে যদি ইশরাক হোসেন প্রার্থী হতে চান তাহলে তাকে এই সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।’
আর যদি এই সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করা হয় তখন কী হবে? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান আইনে এ বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তবে স্থানীয় সরকার কমিশন নতুন যে সংস্কার প্রস্তাব করেছে সেখানে মেয়াদ শেষে ভোট না হলে প্রশাসক বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।’
তার মতে, এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। যে কারণে এখন শপথ নিলে ইশরাক হোসেন কতদিন পদে থাকতে পারবেন তা নিয়ে একটা আইনগত জটিলতা রয়েই গেছে।
এদিকে সোমবার (২৮ এপ্রিল) জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এসময় ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণার পর অনেকে বলেছেন যে এর মধ্যে আওয়ামী লীগের আমলের নির্বাচনকে লিগ্যালাইজ করা হলো কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। এভাবে যারা মামলা করে বা প্লেইন্ড পরিবর্তন করে বিজয়ী হতে চাচ্ছে এটা তাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।
যা বলছে বিএনপি ও ইশরাক হোসেন
ইশরাকের শপথ নিয়ে বিএনপির ভাবনা জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘ইশরাক হোসেনের বিষয়ে দলে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনা হলে বিএনপির করণীয় জানা যাবে।’
জানতে চাইলে ইশরাক হোসেন বলেন, ‘আমি মেয়র পদে শপথ নিলে কতদিন দায়িত্ব পালন করবো, তা বলতে চাই না। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার আইনে বলা আছে। শুধু বলবো, আমি ন্যায়বিচার চাই। আমি মনে করি, আমি পাঁচ বছরের জন্যই নির্বাচিত হয়েছি।’
আমি মেয়র পদে শপথ নিলে কতদিন দায়িত্ব পালন করবো, তা বলতে চাই না। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার আইনে বলা আছে। শুধু বলবো, আমি ন্যায়বিচার চাই। আমি মনে করি, আমি পাঁচ বছরের জন্যই নির্বাচিত হয়েছি।-ইশরাক হোসেন
তিনি বলেন, ‘আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ১০ কর্মদিবসের মধ্যে ইসিকে গেজেট প্রকাশ করতে। সে অনুযায়ী আমাকে মেয়র ঘোষণা দিয়ে ইসি গেজেট প্রকাশ করেছে। এখন সরকার শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। ওটা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানলাম। পরে প্রয়োজনে আনুষ্ঠানিক প্রেস কনফারেন্স করে জানাবো।
প্রথম উদাহরণ চট্টগ্রাম সিটি
এর আগে গত বছরের ১ অক্টোবর বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করেন আদালত।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিন লাখ ৬৯ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছিলেন প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার ভোট।
পরে ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ওই মাসেই নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই মামলার রায়ে শাহাদাত হোসেনকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। পটপরিবর্তনের পর নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে কাউকে মেয়র হিসেবে বিজয়ী ঘোষণার প্রথম নজির সেটি। সূত্র : জাগো নিউজ