নির্বাচন ইস্যুতে ফের বিপরীত মেরুতে বিএনপি-জামায়াত

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই জটিল ও কঠিন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে রাজনীতির মেরূকরণ। বিশেষ করে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য ও অবস্থানে সাধারণ মানুষ

গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন। শুরু থেকেই চলতি বছরের জুনে না হলেও ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল। গত সপ্তাহে জামায়াতের আমিরও বলেন, ‘আগামী রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচন হতে

পারে।’ তার এক দিন পরই মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে রোজার আগে নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু শর্ত জুড়ে দেন। এরপর এক সপ্তাহ না যেতেই গত শুক্রবার ময়মনসিংহে জামায়াতের আমির সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন

দিন। অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে মাঝে বিএনপি ও জামায়াত কিছুটা কাছাকাছি এলেও ফের বিপরীত মেরুতে তাদের অবস্থান।

গত ৫ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর গত ৮ আগস্ট রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ

ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ওঠে সর্বস্তরে। বিএনপি শুরুতে সরকারকে তিন মাস সময় দেওয়ার কথা বললেও পরে দলটির নেতারা জাতীয় নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘যৌক্তিক’ সময় দেওয়ার কথা

জানান। তবে বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী তাড়াহুড়ো না করে টেকসই সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। এসব ছাড়াও এখন আরও কিছু ভিন্ন ইস্যু এতে যোগ হয়েছে।

অবশ্য দুদলের মাঝে আর রাজনৈতিক জোট নেই। অনেকেই বলছেন, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে আন্দোলন করা দল দুটি এখন যেন মুখোমুখি অবস্থানে।

তবে গত ১৬ এপ্রিল জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আগামী রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। সে হিসাবে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী বছর ১৬ ফেব্রুয়ারির পর রমজান শুরু হবে; কিন্তু তার আগেই নির্বাচনের পক্ষে জামায়াত। দলটির এমন অবস্থানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা মনে করছিলেন, নির্বাচন ইস্যুতে অবশেষে জামায়াতের অবস্থান বদলেছে। মানে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির কাছাকাছি চলে আসে জামায়াত। দল দুটি আগেই জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠকের পর নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতের সুরে এই ভিন্নতা আসে।

আরও জানা যায়, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবিতে গত ১৬ এপ্রিল আবারও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। দীর্ঘ পৌনে দুই ঘণ্টার বৈঠকে নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা না পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো তাকে জানিয়েছি, যার মধ্যে প্রধান ছিল নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। আমরা বলেছি, বর্তমানে রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি আছে এবং দেশের যে অবস্থা, তাতে আমরা বিশ্বাস করি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে; কিন্তু বৈঠকের পর আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, ডিসেম্বর মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।

একই দিনে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের ভিউ হচ্ছে, এটা (নির্বাচন) রমজানের আগেই শেষ করতে হবে। জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড়ঝাপ্টা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন আবার ইলেকশনটা (নির্বাচন) অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সে জন্য আমরা চাইছি, ওই আশঙ্কার আগেই যেন নির্বাচন হয়ে যায়।

ওই বক্তব্যের এক সপ্তাহ না যেতেই গত শুক্রবার ময়মনসিংহে জেলা জামায়াতের এক সমাবেশে জামায়াত আমির বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বলেছেন, তারা (ইসি) জাতিকে উদাহরণ সৃষ্টিকারী নির্বাচন উপহার দেওয়ার কথা বলছেন। আমরা তাদের অ্যাসিড টেস্ট দেখতে চাই। আমরা তাদের উদ্দেশে বলছি—স্থানীয় সরকার না থাকার কারণে জাতি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিন। স্থানীয় নির্বাচনের অ্যাসিড টেস্টের মাধ্যমে আপনাদের সক্ষমতা এবং সদিচ্ছা দেখতে চাই। আপনাদের কাজে সন্তুষ্ট হলে জনগণ আপনাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে যাবে। আর যদি তার ব্যত্যয় ঘটে তবে জনগণ আপনাদের লাল কার্ড দেখাবে। কোনো দল বা গোষ্ঠীকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়া হলে তা আমরা কিছুতেই মানব না। আমরা ১৮ কোটি মানুষকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে। এ ছাড়াও গণহত্যা প্রসঙ্গে আমিরে জামায়াত বলেছেন, গণহত্যা সংঘটনকারীদের আইনের বাইরে রাখবেন না। তাদের বিচার নিশ্চিত ও বিচার দৃশ্যমান করুন। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর করতে পর্যাপ্ত সংস্কার করুন। কালো টাকা ও পেশিশক্তি থেকে বের হয়ে এসে সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য সমানুপাতিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে—আগামীর নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে।

এ ছাড়া গত শুক্রবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির মো. নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেছেন, জনদুর্ভোগ লাঘবে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের পাশাপাশি আগামী জুনের মধ্যেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন শেষ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুর বাইরে স্থানীয় সরকার নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর দায়িত্বশীল নেতাদের আবারও রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে কয়েকবার বলেছেন যে, দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার চাইলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে আর ছোট আকারের সংস্কার চাইলে নির্বাচন হতে পারে ডিসেম্বরে। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ঈদ অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও বলেছেন, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; কিন্তু ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন আয়োজনের বিরোধী বিএনপি। তারা চলতি বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়।

তবে নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের সুর বদলালেও নির্বাচন নিয়ে বিএনপি তাদের আগের অবস্থানেই অনড় আছে। জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আমরা বলছি—সংস্কারের জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা নয়। এরই মধ্যে সব দল তাদের সুনির্দিষ্ট মতামত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দিয়েছে। এখন যেসব জায়গায় ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো জাতির সামনে প্রকাশ করে একটি নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করলেই হলো। নির্বাচন হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক অর্ডার ফিরিয়ে আনা। সংস্কার হচ্ছে চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের পর আরও বহু সংস্কার হবে এবং সেটি চলতে থাকবে। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাই এবং এ দাবিতে প্রায় সব দল একমত।

সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলীয় প্রধান ও নেতাদের বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার কালবেলাকে বলেন, আমাদের অবস্থান মোটেও পরস্পরবিরোধী নয়। আমরা দুটি কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাই। প্রথমত, স্থানীয় সরকার নির্বাচন না হওয়ার কারণে গ্রামীণ অবকাঠামো ও উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় প্রশাসনে সরকারি আমলারা দুর্নীতি করছে, জনগণ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই নির্বাচন না হলে বিশাল জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কমবে না আইনশৃঙ্খলাসহ নানা বিষয়ে। দ্বিতীয়ত, বড় কারণ হলো—নির্বাচিত যে কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে সেই সরকারের ধারণা এবং প্রবণতায় হয়, স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলকে তার অনুকূলে নেওয়ার যত প্রশাসনিক ও কালো টাকার চাপ, রাজনৈতিক চাপ তারা সৃষ্টি করে। তাই রাজনৈতিক সরকার আসার আগেই বর্তমান যে অন্তর্বর্তীকালীন বা নিরপেক্ষ সরকার আছে তাদের অধীনেই অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। সেখানেই প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারে। এই কাজটা হওয়ার পর জাতীয় নির্বাচন হোক। এক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক ও নির্বাচন কমিশন সিরিয়াস হলে এটা সম্ভব। সরকার ঘোষিত সময়ের মধ্যেই স্থানীয় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর জামায়াত নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছিল সেভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। জামায়াতের প্রধান নেতার বিভিন্ন রকম বক্তব্য তার প্রমাণ। তিনি একেক সময় একেক রকম কথা বলছেন। তার বক্তব্যে এক ধরনের মিল-অমিল দেখা যাচ্ছে। আমি মনে করি এতে জামায়াতের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় ভিন্ন বক্তব্য দেওয়াতে জাতির জন্য সংকট তৈরি হতে পারে। ফলে জামায়াতের মতো একটি বড় এবং পুরোনো দলের নির্দিষ্ট নীতি বা অবস্থান থাকা উচিত। বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ নেতাদের আরও ভাবনা-চিন্তা করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে জামায়াতে এবং দেশের মানুষেরও ভালো হবে। কেননা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দেওয়ায় জামায়াতের মতো একটি বড় দল মানুষের কাছে হালকা হয়ে যাচ্ছে। তাদের আরও গভীরভাবে বুঝতে হবে যে, তারা সঠিক জায়গায় আছে কি না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *