আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার কি শেষ পর্যন্ত পৌঁছাবে শেখ হাসিনার দরজায়?

২০২৪ সালের মধ্য জুলাই থেকে ৫ আগস্ট—এই সময়টা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। সেই সময় জুড়ে দেশজুড়ে চলা গণআন্দোলন দমন করতে ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর অভিযান চালায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

প্রাণ হারান হাজারো বিক্ষোভকারী, আহত হন আরও অনেকে। এই হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা হিসেবে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে।

জাতিসংঘের একটি গোপনীয় রিপোর্টে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনার সরাসরি আদেশেই এই ‘রাষ্ট্রীয় গণহত্যা’ পরিচালিত হয়েছে। রিপোর্ট অনুসারে, শুধু জুলাই-আগস্টের মধ্যেই ১,৪০০-রও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে যার সাথে হাসিনা এবং তার দলের শীর্ষ নেতারা সরাসরি যুক্ত। এই রিপোর্ট এখন আন্তর্জাতিক মহলেও হাসিনাকে ‘একজন মানবতা বিরোধী অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

হত্যাযজ্ঞের পর পরই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানে গোপনে অবস্থান করলেও তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে দেশে উঠেছে প্রবল জনচাপ। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যেই ভারতের কাছে সকল প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানায়।

কিন্তু দিল্লি এখনো এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বরং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত হাসিনাকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ধরে রেখে বাংলাদেশকে আবারো অস্থির করতে চায়।

উপায়ান্তর না দেখে বাংলাদেশের পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (NCB) সম্প্রতি ইন্টারপোলের কাছে শেখ হাসিনা সহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছে। এই তালিকায় আরও আছেন বিতর্কিত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, যার বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ যুক্ত করে আবেদন করা হয়েছে।

আবেদনের মধ্যে ১০ জনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণও সংযুক্ত করা হয়েছে। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দপ্তর ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে পুলিশকে রেড অ্যালার্ট জারি করতে অনুরোধ করেছিল।

যদিও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি বিদ্যমান, ভারত এখনো শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণে আগ্রহ দেখায়নি। এর ফলে দিল্লির আকাশে ঘনিয়েছে কূটনৈতিক সংকটের মেঘ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও শেখ হাসিনাকে ঘিরে চলছে গুঞ্জন, উদ্বেগ আর জল্পনা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত চায় না শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিচারবিভাগীয় জবাবদিহির মুখোমুখি হোক। কারণ, এতে উঠে আসতে পারে একাধিক রাষ্ট্রীয় ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা।

জাতিসংঘের রিপোর্ট, দেশের অভ্যন্তরে চাপ, আন্তর্জাতিক আইন, এবং ইন্টারপোল—সব মিলিয়ে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার লড়াই এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি ও ইন্টারপোল—এই দুই পথেই এগোনো হচ্ছে, তবে ভারত বাধা হয়ে দাঁড়ালে সেই পথ কঠিন হয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন একটাই—আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার কি শেষ পর্যন্ত পৌঁছাবে শেখ হাসিনার দরজায়? নাকি এই নৃশংস গণহত্যার দায় চাপা পড়ে যাবে আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *