ট্রাম্পের তোপের মুখে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান

শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় অনেক রয়েছে, তবে হার্ভার্ড যেন এক অন্য স্তরের নাম, একটি ‘এন্ট্রি টিকিট টু দ্য এলিট’। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন।

তিনি চান, বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন ‘চুকায় তার পাপ’। তবে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আপাতত নতিস্বীকার করতে রাজি নয়। পেশাগত জীবন শুরু করতে হলে অনেক কিছুই সিভিতে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়,

ডিজাইন, অভিজ্ঞতার বর্ণনা, সৃজনশীল উপস্থাপন। তবে এর বাইরেও কিছু নাম আছে, যেগুলো নিজেই নিজের পরিচয় বহন করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সেই রকমই একটি ‘সিলমোহর’, ভালো হোক বা মন্দ।

বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হার্ভার্ডের অবস্থান বরাবরই উপরের সারিতে। যদিও সাম্প্রতিক র‌্যাংকিংয়ে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এগিয়ে গেছে, তবু ‘বিশ্বখ্যাত’ শব্দটি হার্ভার্ডের সঙ্গে একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে।

টাইমস হায়ার এডুকেশন–এর করা সবচেয়ে সম্মানজনক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় টানা ১৪ বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে হার্ভার্ড। ২০২৫ সালে এই তালিকায় প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ৯৯.৯ পয়েন্ট (১০০-এর মধ্যে)।

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

১৬৩৬ সালে প্রোটেস্টান্ট যাজক জন হার্ভার্ডের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাচীন। শুরুর দিকে এটি ছিল একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে এটি বিজ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক আধুনিক রূপ নেয়।

হার্ভার্ডে উদ্ভাবিত বা সংশ্লিষ্ট কিছু উদ্ভাবনের তালিকা বিশাল—বেকিং সোডা, ডিফিব্রিলেটর, অঙ্গপ্রতিস্থাপন পদ্ধতি, গলফ টিসহ নানা উদ্ভাবন রয়েছে এর মধ্যে। এমনকি ফেসবুকের সূচনাও হয় হার্ভার্ডের ছাত্র মার্ক জাকারবার্গের হাত ধরে ২০০৪ সালে, প্রাথমিকভাবে হার্ভার্ডের ছাত্রদের জন্য একটি ডিজিটাল ডিরেক্টরি হিসেবে।

তবে কেন ট্রাম্পের রোষানলে হার্ভার্ড?

ডেনমার্কের গণমাধ্যম DR–এর মার্কিন প্রতিনিধি মালথে সোমারান্ড বলছেন, “হার্ভার্ড একটি ধনী প্রতিষ্ঠান। ট্রাম্প যেসব সরকারি ভর্তুকি কাটছাঁট করতে চান, তার প্রয়োজন হার্ভার্ডের নেই। তবে দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধে যাওয়া টেকসই নয়।”

বিশ্ববিদ্যালয়টির পেছনে রয়েছে একটি ফাউন্ডেশন, যার সম্পদের পরিমাণ ৫০০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই তহবিল বড় হচ্ছে দান ও বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে দানের অর্থ করমুক্ত, কারণ হার্ভার্ড একটি বেসরকারি, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।

তবে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বড় সুবিধা কেড়ে নেওয়ার: করমুক্ত মর্যাদা এবং বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির অধিকার। উল্লেখ্য, হার্ভার্ডে স্নাতক পর্যায়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ এবং এদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ফি পাওয়া যায়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের একটি বড় উৎস।

ট্রাম্প এবং যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল মহল মনে করে, হার্ভার্ড ও অন্যান্য আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘ওয়োক’ মতাদর্শ ও উদারনৈতিক চিন্তার আঁতুড়ঘর।

২০২২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, হার্ভার্ডের ইতিহাসের সঙ্গে দাসপ্রথার গভীর সম্পর্ক ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাথমিক সম্পদের একটি বড় অংশ এসেছিল দাস ব্যবসা থেকে। এমনকি ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, হার্ভার্ডের শিক্ষার্থী ও কর্মীদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই নিজেদের ‘লিবারাল’ বা ‘খুব লিবারাল’ বলে চিহ্নিত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা এখনো সবার নাগালের বাইরে। ৪০ শতাংশের কম মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা লাভ করেন, আর হার্ভার্ড বা আইভি লিগে শিক্ষালাভ করা মানুষের সংখ্যা তো আরও নগণ্য। তাই ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশলে এসব প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে সহজ টার্গেট।

“ট্রাম্প অভিজাতদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেন। আর এই অভিজাতরা আসে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই। ট্রাম্পের সমর্থকরা এসব প্রতিষ্ঠানের ধারে-কাছেও নেই। ফলে তাদের ওপর আক্রমণ শাণালেও ভোট হারানোর ঝুঁকি নেই,” বলেন সোমারান্ড।

অবশ্য ট্রাম্প নিজেও একটি আইভি লিগ প্রতিষ্ঠানের স্নাতক। তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া থেকে।

তবু, আজকের দিনে এসে হার্ভার্ডই যেন হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ও সংস্কৃতির প্রতীক এবং সেই প্রতীকের ওপর ট্রাম্পের ক্ষোভও যেন অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে তীব্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *