নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির ৯ বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান মিললো

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৯টি ফ্ল্যাট ও বাড়িসহ দেশে-বিদেশে ৬৮ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ‘অবৈধ’ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

এই ‘অবৈধ’ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলার অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। মামলাটি দায়ের করছেন দুদকের উপপরিচালক নুরুল হুদা।

বুধবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি প্রক্রিয়াধীন থাকার কথা জানিয়ে দুদকের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আক্তার হোসেন বলেন, আবদুস সোবহান গোলাপ ক্ষমতার অপব্যবহার,

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কুইন্সে ৯টি ফ্ল্যাট ও বাড়ি গড়েছেন, যার মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩২ কোটি টাকা। ৩২ কোটি ৩৪ লাখ ২৭ হাজার ৯৬০ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ৩৭ কোটি ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭ টাকার অস্থাবর

সম্পদ অর্জন ও পারিবারিক ব্যয় ২৫ লাখ ৮২ হাজার ২৬৭ টাকা মিলিয়ে গোলাপ মোট ৬৯ কোটি ৭৬ লাখ ৭৯ হাজার ২৯৪ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এই অর্জিত সম্পদের বিপরীতে তাঁর বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় ১ কোটি ৪৪ লাখ ৩ হাজার ৬২৯ টাকা। বাকি ৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৫ টাকার সম্পদ তিনি ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে’ অর্জন করেছেন।

দুদকের ডিজি আরও বলেন, আবদুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানে তাঁর নিজের ৫১টি ব্যাংক হিসাবে ৯৭ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৮ টাকার ‘অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের’ অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়েছে।

৯ জানুয়ারি গোলাপ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দেয় আদালত। একই সঙ্গে তাদের ৫৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দিয়েছেন। আদালতের সম্পদ জব্দের আদেশের তথ্য অনুযায়ী, কারাগারে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য গোলাপ, তার স্ত্রী গুলশান আরা মিয়া, ছেলে ইভান সোবহান মিয়া ও মেয়ে আনিশা গোলাপ মিয়ার নামে এসব স্থাবর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে গোলাপ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা মিরপুরের একটি পাঁচতলা বাড়িও জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাড়িগুলোর মধ্যে আটটি সিঙ্গেল রেসিডেনসিয়াল কন্ডো ইউনিট এবং অপরটি ডুয়েল ফ্যামিলি ইউনিট বলে তথ্য দেওয়া হয়েছে দুদকের আবেদনে। গত বছরের ২ অক্টোবর সাবেক এ সংসদ সদস্যের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় একই আদালত। সরকার পতনের পর আত্মগোপনে থাকা গোলাপকে রাজধানীর নাখালপাড়ার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ঢাকায় একটি হত্যার ঘটনাসহ একাধিক অভিযোগে মামলা রয়েছে।

এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবদুস সোবহান মিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৯টি বাড়ি কেনার অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এই নির্দেশ দেওয়া হয়। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারিসহ এই আদেশ দেন। রুলে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৯টি বাড়ি কেনার অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আবদুস সোবহান গোলাপের ৯টি বাড়ি কেনার অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, এনবিআরের চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে। এছাড়া রিটে আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার বাড়ি কেনার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়।

ওই সময়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি তাদের ওয়েবসাইটে করা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। বিষয়টি নির্বাচনী হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেননি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি সুউচ্চ ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে মোট ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)।

মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। তিনি দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *