সংস্কারে যত বেশি সময় যাবে সমস্যা তত বাড়বে: মির্জা ফখরুল

সরকারের প্রশাসন ‘পুরোপুরিভাবে ফ্যাসিবাদের মধ্যে আছে’ বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার সকালে ‘ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজে’র আয়োজিত জাতীয় সংলাপের প্রথম অধিবেশনে বিএনপি মহাসচিব দেশের বর্তমান প্রশাসনের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘‘ সংস্কার নিয়ে যত বেশি সময় যাবে আমার কাছে মনে হয়, আমাদের কাছে মনে হয় যে, সমস্যাগুলো তত বাড়বে। আসল প্রবলেম তো অন্য জায়গায়। আপনি এটা ইমপ্লিমেন্ট করবেন কাদের দিয়ে?” ‘‘আপনার এই যে, প্রশাসন গভমেন্ট ম্যাসিনারী, সেই গভমেন্ট ম্যাসিনারী তো পুরোপুরিভাবে এখনো ফ্যাসিবাদের মধ্যে আছে।এতটুুক পরিবর্তন হয়নি।”

আমলাতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন ‘‘ একটা ফাইল নড়ে না। ছাত্রদের মধ্যে যারা আহত হয়েছে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা কোথায় আটকে আছে, খুঁজে বের করে দেখবেন ‘এই বিষয়গুলো আমাদেরকে দেখতে হবে। ড. দেবপ্রিয় এখানে আছেন, ড. মুশতাক হোসেন খানও বলেছেন যে, কাঠামোটা যদি না থাকে, সেই কাঠামো না থাকলে আমরা উপর থেকে শুধু চাপিয়ে দিলে দ্রুত কোনো কিছু করতে পারবো না।”

তিনি বলেন, ‘‘ তাই আমাদের স্টাকচার ঠিক করতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হবে।সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি আমরা গণতন্ত্র উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারি তাহলেই আমরা গণতন্ত্রকে সফল করতে পারব।” ‘‘মন-মানসিকতাটা খুব বড় জিনিস মাইন্ডসেট । আমার তো মাইন্ডসেট হয়ে গেছে যে কথাটা কিছুক্ষন আগে এই কথাটা ড. মুশতাক বলেছেন, আমার খুব ভালো লেগেছে। একটা বন্দোবস্ত তো ছিলো, টাকা দেবো কাজ করিয়ে নেবো ভালো, সমস্যা নেই।

এখন তো আপনি অন্য সিষ্টেমে যাচ্ছেন সেই মাইন্ডসেটটা তো তৈরি করতে হবে এবং তৈরি করার জন্যই চর্চা দরকার, আমাকে গণতন্ত্রকে চর্চা করতে হবে..ভুল হবে, ত্রুটি হবে এর মধ্য দিয়ে আপনাকে ব্যুরোক্রেসি সিষ্টেমকে সামনের নিয়ে যেতে হবে।” ফার্মগেইটে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে সংস্কার, নির্বাচন বিষয়ক এই জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠান হয়। দুইদিন ব্যাপী এই জাতীয় সংলাপে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস।

‘৭১ ভুলা যাবে না’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা যেন একাত্তরকে ভুলে না যাই, ১৯৭১ সাল এটাকে যেন আমরা কখনো ভুল না যাই। আমরা যেন এই যে ধারাবাহিক গণতন্ত্রের জন্য যে সংগ্রাম, লড়াই, একাত্তরের পর থেকে সেই সংগ্রাম প্র্রত্যেকের মনে রাখা দরকার।”

‘‘সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে, তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা এই জায়গায় উপস্থিত হয়েছি। সুতরাং আমরা আপনাদেরকে এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে সব সময়ই গণতন্ত্রের সংস্কারের পক্ষে ,গণতন্ত্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের পক্ষে তার জন্য আমরা কাজ করেছি, করব ভবিষ্যতে। একই সঙ্গে আমরা মনে করি যে, জনগনকে বাদ দিয়ে ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কোনো কিছু করা যাবে। আমরা চাই, সকলকে সঙ্গে নিয়ে সেই কাজগুলো করব।”

‘ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করতে হবে’
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন, ‘‘ সাড়ে ১৫ বছরে লেয়ারের পর লেয়ার যে ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে একদিনে, দুইদিনে বা চার মাসে সেটা নিরসন সম্ভব নয়। এটার জন্য সমর্থন লাগবে, জনগনের প্রেসার লাগবে।” ‘‘আপনারা দেখেছেন বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে আমার বিস্তারিত বলার দরকার নাই। বারে বারে জাতীয় পতাকাকে খামছে ধরার চেষ্টা করছে সেই পুরনো শকুন। প্রতিহতের জায়গা আমাদের বজায় রাখতে হবে।খালি ঐক্যের কথা বললাম, প্রতিহতের জন্য তৈরি থাকলাম না, নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেবেন না। যখন নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেবেন আপনাদের হাতের বাইরে চলে যাবে।

সেই কারণেই আমাদের সকলের মাথায় চিন্তা থাকতে হবে আমরা একটা অসমাপ্ত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সমাপ্ত করার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, আমরা একটা ফ্যাসিবাদের বাংলাদেশ ব্র্যান্ডকে পরাজিত করে আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছি।আমরা যে বাংলাদেশ চাই, সেই বাংলাদেশে যেন কখনই আর ফ্যাসিবাদ ফেরত না আসে।”

তিনি বলেন, ‘‘ বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদের ব্র্যান্ডের নাম ছিলো মুজিববাদ।সেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করতে যেয়ে বাংলাদেশের যেই তরুন-যুবকরা জীবন দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন তারা আজকে কেমন বাংলাদেশ চান, তারা আজকে বাংলাদেশটাকে কিভাবে গড়ে তুলতে চান, বাংলাদেশের রাজনীতিটা কেমন হবে, সংবিধানটা কেমন হবে, নির্বাচনটা কেমন হবে শুধু সেটাতে আমরা থাকবো।” ‘তার সঙ্গে এটাও বলব, উচ্চ কক্ষ-নিম্ন কক্ষ বা রিপ্রেজেনটেশন কেমন হবে শুধু সেটা না, স্থানীয় পর্যায় ক্ষমতার ভিত্তি কেমন হবে… সমস্ত ক্ষমতা কি সংবিধানে সংসদ সদস্যদের প্রতি দেয়া থাকবে নাকি স্থানীয় পর্যায় স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে যেখানে সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থান থাকবে এই প্রক্রিয়াটাই বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের মধ্য দিয়ে আসবে।

‘জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘‘সংস্কার, সংলাপ, জাতীয় ঐক্যমতের প্রশ্নের আমি বলব,সরকারের পক্ষ থেকে যে রিফর্ম কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে…. সেই্ কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল।সহজ পথ হলো, আমরা পরামর্শ দিয়েছি, সব দল দিচ্ছে আমি কমিশনের প্রধানদের অনুরোধ করব, প্রধান উপদেষ্টার কাছে ম্যাসেজ দিতে চাই, এগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে হয়ত এসে যাবে। আসার পর এগুলোকে সর্টআউট করে রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের কাছে থেকে আসা সমস্ত সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় ঐক্যের দৃষ্টিতে যেগুলো কমন সেগুলো নিয়ে আরেকটি পাবলিক ডায়ালগের ব্যবস্থা আপনারা করুন।সেখানে একটা জাতীয় ঐক্যমত তৈরি হতে পারে।”

‘আর সংস্কার বিশাল ব্যাপার। রাষ্ট্রের সমস্ত অর্গানগুলো পলিটিসাইজ হয়েছে এবং করাপ্ট হয়েছে এটা একটা অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সব কিছু সংস্কার করা সম্ভব নয়।ইট উইল টেক টাইম। কিন্তু একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে সংস্কারগুলো মিনিমাম প্রয়োজন সেগুলো সম্পন্ন করতে সুযোগ দিতে হবে। তারপরেই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, গ্রহনযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। সেই নির্বাচনে যুক্তিসঙ্গত সময়ের জন্য যতটুকু লাগে আমরা জামায়াতে ইসলামী সেই সময়ে দিতে অন্তর্বতীকালীন সরকারকে দিতে প্রস্তুত আছি।

ড. জাহেদ উর রহমানের সঞ্চালনায় প্রথম অধিবেশনে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভূট্টাচার্য, সংবিধান বিষয়ক সংস্কার কমিটির প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণফোরামের সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নূর, বাংলা একাডেমির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ফজলুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *