
ফেনী নদীর উৎপত্তি বাংলাদেশে; অথচ এর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে ভারত। কোনো চুক্তি ছাড়াই এক যুগ ধরে ৩৭টি স্থানে পাম্প বসিয়ে এই নদী থেকে অবিরাম পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
এ ঘটনায় বুধবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহ বন্ধের দাবিতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যৌথ নদী কমিশনের সদস্যকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান।
এর আগেই ভারতের একতরফা আগ্রাসনে পানি শুকিয়ে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে ফেনী নদীতে। যে দিকে চোখ যায় শুধুই বালুচর। বলতে গেলে খরস্রোতা ফেনী নদী এখন মৃতপ্রায়। এ অবস্থায় ভারতে ইনটেক ওয়েল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মুহুরি সেচ প্রকল্প হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ফেনী নদীর উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়ি জেলার ভগবান টিলা এলাকায়। চট্টগ্রামে মিরসরাইয়ের আমলীঘাট পর্যন্ত প্রায় ৮৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখা হিসেবে চিহ্নিত। একসময় এই ফেনী নদী ছিল খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়, গুইমারা ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার অধিবাসীদের নৌপরিবহন ও যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ভারতের ভিতর থেকে যেসব ছড়া-নালা দিয়ে পানি একসময় ফেনী নদীতে এসে পড়তো, সেখানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা হয়েছে। আর ফেনী নদীর তীরের ২০ থেকে ৫০ গজের মধ্যে অবৈধভাবে পাকা হাউজ নির্মাণ করে মাটির নিচ দিয়ে নদীতে পাইপ ফেলে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে ভারত।
ফেনী নদীতে ভারতীয় পক্ষের এ ধরনের পানির পাম্প রয়েছে ৩৭টি স্থানে। যা দূর থেকে বোঝার কোনো সুযোগ নেই। এসব পাম্প দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭৫ কিউসেক পানি উত্তোলন করছে ভারত। আর এ পানি দিয়ে ফেনী নদীর তীরে সবজিসহ নানা প্রজাতির ফসলের চাষ করছে ভারতের কৃষকেরা।
কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকরা ফেনী নদীর পানি তুলতে গেলে যত বিপত্তি। বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে আসে বিএসএফ। কখনও কখনও নদীতে গোসল করতে গেলেও বাধা দেয়া হয়।
২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর নয়া দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে শীর্ষ বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের সাবেক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুই সরকার প্রধানের বৈঠক শেষে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয়।
এ সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি উত্তোলন করতে পারবে ভারত। ওই পানি ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে।
সূত্রটি বলছে, ফেনী নদীর পানি চুক্তির আলোকে ২০১০ সালে যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকে সাবরুম শহরের মানুষের খাবার পানি সরবরাহের জন্য ১.৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে কারিগরি কমিটির বৈঠকে ৭টি শর্তসাপেক্ষে খাবার পানি সরবরাহের জন্য ‘লো লিফট’ পাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২০১৯ সালের আগস্টে ঢাকায় সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও বাংলাদেশ এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ভারতে দুই দেশের রাষ্ট্র প্রধানের শীর্ষ বৈঠকে এ সমঝোতা স্মারক সই হয়।
এ বৈষম্যমূলক সমঝোতা স্মারকের প্রতিবাদ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার অপরাধে ২০১৯ সালের ৬ই অক্টোবর রাতে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ছাত্রলীগের একদল সন্ত্রাসীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনীস্থ-৪ বিজিবির অধিনায়ক লে.কর্ণেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ‘দৈনিক আমার দেশ’কে বলেন, তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেনী অংশের ৩ কিলোমিটার এলাকার কোথাও এমন কোনো পাম্প বসানো কিংবা পানি উঠানো হচ্ছে না।
তবে, রামগড়ের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাফেজ আহমেদ ভূঁইয়ার অভিযোগ, ওই অংশে বিনা বাধায় ভারত একতরফা ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নেয়ার পাশাপাশি নদী তীরবর্তী তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সাবরুম পানি সরবরাহের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ফেনী নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। হুমকির মুখে পড়বে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মুহুরি সেচ প্রকল্প।
একইভাবে ফেনীর প্রবীণ সাংবাদিক একেএম আবদুর রহিম বলেন, ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে বলা আছে, সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে উভয় পাশে ১৫০ গজের ভিতরে কেউ স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করতে পারবে না। অথচ ভারত সে চুক্তি লঙ্ঘন করে ফেনী নদীর কূলঘেঁষে মাত্র ২০ থেকে ৫০ গজের মধ্যে বেআইনিভাবে ৩৭টি পাকা পাম্প হাউজ তৈরি করে পানি তুলে নিচ্ছে। ফলে ফেনী নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ফেনী নদী ইতিহাস হবে।
এদিকে পানি সরবরাহ বন্ধের দাবিতে বুধবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যৌথ নদী কমিশনের সদস্যকে পাঠানো আইনি নোটিশে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ‘ভারত সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরে পানি সরবরাহের জন্য বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক করে পানি নিয়মিত উত্তোলন করবে।’
‘সমঝোতা স্মারক কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তি নয়। বাংলাদেশ সরকার বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৫ ও ১৪৫-এ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি রাষ্ট্রপতির কাছে উত্থাপন করতে হবে এবং সংসদের বৈঠকে পেশ করতে হবে।’
‘‘কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়াই বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে— যা আমাদের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ভারতে পানি সরবরাহের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাবে না। যেকোনও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে অবশ্যই ‘বিনিময়’ থাকবে। কিন্তু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাবে না।’’
‘এখানে আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, এই সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ভারত সরকারকে বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভারত সরকার তাদের নিজস্ব পাম্প দিয়ে বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলন করবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যদিও সমঝোতা স্মারকে ১.৮২ কিউসেক পানি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ভারত অসংখ্যা পাম্প দিয়ে অধিক পরিমাণে পানি নিয়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ফেনী নদী পরিবেশগত ব্যাপক সংকটের মুখে আছে এবং ক্রমাগত অস্তিত্বের হুমকিতে রয়েছে।’
‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র ছাড়াই এবং কোনো রূপ বিনিময় ছাড়াই বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া ভারত সরকারকে তাদের পাম্প দিয়ে পানি উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হয়েছে।’
তাই এই আইনি নোটিশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সরবরাহ বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে এবং ফেনী নদীর ওপর থেকে ভারতের সব পানির পাম্প অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে। অন্যথায়, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।