
তখন সকাল ১০টা ৫ মিনিট। আজ বুধবার এই সময়ে দেখা গেল, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানার প্রধান ফটকের সামনে সারিবদ্ধভাবে ৫০ জন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে।
হাজতখানার সামনে থাকা পুলিশ সদস্যদের ইশারা দিলেন ঊর্ধ্বতন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের পেছনে দুই হাত। তাঁর দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
তখন দেখা গেল, হাজতখানার ভেতর থেকে মাথা নিচু করে সামনের দিকে আসছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তাঁর পরনের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় পুলিশের হেলমেট। বুকে পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। দুই হাত পেছনে মোড়ানো। দুই হাতেই হাতকড়া (হ্যান্ডকাফ)।
সালমানের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। তাঁর মাথায় হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাঁর দুই হাতও পেছনে ছিল। তবে তাঁর দুই হাতে হাতকড়া পরানো ছিল না।
শুধু বাঁ হাতে ছিল হাতকড়া। আর ডান হাত তিনি বা হাতের ওপরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মামুনের পেছনে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তাঁর পরনে ছিল আকাশি রঙের পাঞ্জাবি। তাঁর দুই হাত পেছনে ছিল। দুই হাতেই পরানো ছিল হাতকড়া।
আনিসুলের পেছনে ছিলেন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। তাঁর মাথায় হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাঁর দুই হাতও পেছনে ছিল। পরানো ছিল হাতকড়া।
নুরুজ্জামানের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তাঁর দুই হাতও পেছনে ছিল। তবে তাঁর এক হাতে পরানো ছিল হাতকড়া।
জাকবের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের মাথায় ছিল হেলমেট। বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাঁর এক হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। দুজন পুলিশ সদস্য তাঁর দুই হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটছিলেন।
এর বাইরের আজ প্রায় একই সময়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে দুজন নারী পুলিশ সদস্য তাঁকে হাত ধরে হাজতখানার বাইরে নিয়ে আসেন।
এরপর সালমান, আনিসুল, নুরুজ্জামানদের আদালত ভবনের নিচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে দোতলায় ওঠানো হয়। এরপর তাঁদের একে একে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়।
সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের পেছনে দুই হাত। তাঁর দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের পেছনে দুই হাত। তাঁর দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশছবি: আসাদুজ্জামান
কাঠগড়ায় তোলার পর আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামানের হাতকড়া খোলা হয়। যখন পুলিশ তাঁদের হাতকড়া খুলছিল, তখন তিনজনেরই মুখ ছিল নিচের দিকে। হাতকড়া খোলার পর বিমর্ষ মুখে সালমান তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন।
আনিসুল-সালমান-দীপুর কথোপকথন
আনিসুল-সালমানদের কাঠগড়ায় তোলার পর সারিবদ্ধভাবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাঁদের সামনে দাঁড়ান। তখনো বিচারক এজলাসে আসেননি।
সালমান তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। পাশে দাঁড়ানো আনিসুলও তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপু মনি।
দীপু মনির ডান পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন নুরুজ্জামান। নুরুজ্জামানের বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাজি সেলিম। হাজি সেলিমের দিকে নুরুজ্জামান চেয়েছিলেন। তিনি মুখের ইশারায় হাজি সেলিমের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, কেমন আছেন। হাজি সেলিম মুখ নাড়েন।
এ সময় আনিসুলের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন দীপু মনি। তাঁরা প্রায় দুই থেকে তিন মিনিট ধরে কথা বলতে থাকেন। আনিসুল পরে সালমানের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এরপর সাবেক আইজিপি মামুনের সঙ্গে কথা বলেন সালমান।
প্রায় ১০ মিনিটে ধরে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সালমান, আনিসুল, দীপু মনিরা কথা বলেন। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য উচ্চ স্বরে বললেন, ‘স্যার (বিচারক) আসছেন।’ যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা জেহাদ হোসেন হত্যা মামলায় আনিসুল ও মামুনকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আজ আদালতে আবেদন করে পুলিশ।
শুনানিতে ঢাকা মহানগর দায়রে জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এলাকায়। এ সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচার গুলি করে মানুষ হত্যা করেছেন। আর এসব হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক আইজিপি মামুন সরাসরি জড়িত। নিরীহ ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে।
পিপির এই বক্তব্যের পর সাবেক আইজিপি মামুনের আইনজীবী আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেলের ইতিমধ্যে ৮৫ দিন রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। তিনি সাবেক পুলিশপ্রধান। কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।
মামুনের আইনজীবী রিমান্ডের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য দেন। আনিসুলের পক্ষের আইনজীবী আদালতে উপস্থিত থাকলেও তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। এ সময় আনিসুল বিচারকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
শুনানি শেষে এই মামলায় আনিসুল ও মামুনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এরপর যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা ওয়াসীম হত্যা মামলায় আনিসুলের তিন দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। এ সময় পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, আনিসুল হক জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী।
এই মামলার শুনানিতেও আনিসুলের আইনজীবীরা রিমান্ডের বিরোধিতা করে কোনো বক্তব্য দেননি। আদালত শুনানি নিয়ে আনিসুলের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তখনো নির্বাক আনিসুল বিচারকের দিকে চেয়েছিলেন।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পেছনে দুই হাত। তাঁর এক হাতে হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পেছনে দুই হাত। তাঁর এক হাতে হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশছবি: আসাদুজ্জামান
ব্যারিস্টার পুত্রবধূর সঙ্গে হাজী সেলিমের আলাপ
সাদা রঙের লম্বা পাঞ্জাবি পরা হাজী সেলিম কাঠগড়ায় প্রথমে ছিলেন নিশ্চুপ। হাজী সেলিমের আইনজীবী প্রাণনাথ রায় তাঁর মক্কেলকে (হাজী সেলিম) উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি কেমন আছেন?’
এ সময় হাজী সেলিম মাথা নাড়তে থাকেন। তখন আইনজীবী প্রাণ নাথ রায় হাজী সেলিমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা চিটাগাং গিয়েছিলাম।’ তখনো হাজী সেলিম মুখ নাড়ছিলেন।
বিচারক এজলাসে আসার পর হাজী সেলিমকে যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে পুলিশ। এ সময় তাঁর আইনজীবী আদালতে বলেন, ‘আমার মক্কেল কোনো কথা বলতে পারেন না। এ জন্য হয়তো আজ আমার মক্কেলের রিমান্ড চাওয়া হয়নি। আমার মক্কেল লালবাগে থাকেন। তিনি একসময় লালবাগ এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁকে যাত্রাবাড়ী থানার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তিনি কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। তিনি অসুস্থ। তাঁকে জামিন দেওয়া হোক।
এরপর হাজী সেলিমের আইনজীবী আদালতকে, ‘আমার মক্কেলের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলার অনুমতি চাচ্ছি।’
আদালত অনুমতি দেওয়ার পর আইনজীবী প্রাণনাথ রায় কাঠগড়ার দিকে এগিয়ে যান। তখন হাজী সেলিমের সামনে একজন নারী আইনজীবী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হাজী সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। এ সময় নারী আইনজীবী হাজী সেলিমকে কাগজে লেখা একটি চিঠি দেখান। হাজী সেলিম তখন একমনে পড়তে থাকেন। আইনজীবী প্রাণনাথ ও নারী আইনজীবী হাজী সেলিমকে তাঁর ব্যবসায়িক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তথ্য জানাতে থাকেন।
হাজী সেলিমের সঙ্গে কথোপকথন শেষ হলে আইনজীবী প্রাণনাথ রায় প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের অনুমতি নিয়ে নারী আইনজীবী তাঁর মক্কেলের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি একজন ব্যারিস্টার। তিনি হাজী সেলিমের পুত্রবধূ। হাজী সেলিম মুখে কথা না বলতে পারলেও তিনি লেখা পড়ে বোঝেন। হাতের ইশারা কিংবা মুখের ইশারাও তিনি বোঝেন।
পেছনে দুই হাত, পরানো হাতকড়া
গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের শুনানির পর সালমান, আনিসুল ও নুরুজ্জামানদের মাথায় আবার হেলমেট পরানো হয়।
কাঠগড়া থেকে সবার আগে বের করা হয় দীপু মনিকে। তাঁর দুই হাত ধরেছিলেন দুজন নারী পুলিশ সদস্য। এরপর একে একে হাজী সেলিম, সালমান, আনিসুল, নুরুজ্জামানদের কাঠগড়া থেকে থেকে আদালতের বারান্দায় নিয়ে আসা হয়।
তখন দেখা যায়, আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামানদের দুই হাত পেছনের দিকে। দুই হাতেই লাগানো হাতকড়া। মাথা নিচু করে আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামান আদালতের হাজতখানার ভেতরে ঢুকে যান।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়। ১৩ আগস্ট প্রথম গ্রেপ্তার হন আনিসুল ও সালমান। এরপর তাঁদের বহুবার আদালতে তোলা হয়েছে। তখন তাঁদের এক হাতে হাতকড়া পরানো অবস্থায় দেখা গেছে। তাঁরা দুই হাত সামনে রেখে আদালতের কাঠগড়ায় উঠতেন। আজ বুধবারই প্রথম তাঁদের দুহাতে পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরানো অবস্থায় দেখা গেল।
এ প্রসঙ্গে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামানকে যে পেছনে দুই হাত নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে, সে তথ্য তাঁর নজরে আসেনি। তিনি মনে করেন, এভাবে কোনো আসামিকে আদালতে তোলা উচিত নয়। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ আসামিদের দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তুলে থাকে।