তরুণদের বিশ্বনেতা ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস’

চুরাশিতেও টগবগে তারুণ্যে ভরপুর তিনি। এখনো প্রাণবন্ত, কর্মমুখর। বয়সের ভারে ন্যুব্জ না হয়ে বরং তিনি তারুণ্যকে অবগাহন করেছেন। তারুণ্যের শক্তিতে বিশ্বাসী বলেই এখনো তিনি নিজেই একজন টগবগে তরুণ।

এ জন্যই সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনীতে ভরপুর তিনি। সারাক্ষণ পৃথিবীর কল্যাণ নিয়ে ভাবেন। এখন তিনি বাংলাদেশের দায়িত্বে। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুধু বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নন, তিনি বিশ্ব তারুণ্যের আইকন।

তরুণদের বিশ্বনেতা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দর্শনের মূল ভিত্তি হলো—তারুণ্যের অফুরন্ত শক্তিকে কাজে লাগানো। তিনি বিশ্বাস করেন, তরুণদের মেধা, চিন্তা, সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনকে কাজে লাগালেই বিশ্ব বিকশিত হবে।

যুদ্ধ, হানাহানি, জলবায়ুর ঝুঁকি, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে দরকার তরুণদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি, তাঁদের নীতিনির্ধারণে যুক্ত করা। তরুণদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা জীবন কাজ করে যাচ্ছেন ড. ইউনূস। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যা কিছু করেছেন,

যা কিছু ভেবেছেন, সব কিছু তারুণ্যের স্বপ্নকে ঘিরে। আর এখন দেশ পরিচালনায় তরুণদের সামনে এনে সারা বিশ্বের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী এই প্রাজ্ঞজন।

আগামী দিনে বিশ্ব বদলের মডেল হবে বাংলাদেশ। যখন বাংলাদেশ এক কঠিন সময়ে, স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথরের পৃষ্ঠে দেশের জনগণ, মুক্তির পথ খুঁজে না পাওয়ায় হতাশা সবার মধ্যে, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের তারুণ্যের এক অভূতপূর্ব জাগরণ হলো।

জুলাই বিপ্লব আসলে তারুণ্যের বিপ্লব, তাদের সম্মিলিত বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। প্রচলিত ঘুনে ধরা ব্যবস্থা, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তারুণ্যের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের ভাষা,

তরুণদের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা অনেকেই বুঝতে পারেননি, এখনো পারছেন না অনেকে। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর এ কারণেই তিনি তরুণদের এই আন্দোলনকে মনে-প্রাণে সমর্থন জানিয়েছিলেন।

তিনি জানতেন, তরুণরাই পারবেন বাংলাদেশের বুক থেকে পাথর নামাতে। অবশেষে তরুণরা যখন সাড়ে ১৫ বছরের জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেন, তখন তাঁরা একজন নেতা খুঁজছিলেন,

যে নেতা তরুণদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে। তরুণদের ভাবতে সময় লাগেনি। মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা ঠিক করেন ড. ইউনূসই হবেন তাঁদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই মানুষটি নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা স্বভাবের, প্রচার বিমুখ। তিনি নিজের কাজ নিয়ে মেতে থাকতে পছন্দ করেন। মানবতার কল্যাণে, বিশ্ব কল্যাণের জন্য তিনি আত্মোৎসর্গকারী এক প্রাণ।

এ ধরনের রাজনীতির ডামাডোলের মধ্যে নিজেকে জড়াবেন? এর আগেও ২০০৭ সালে তাঁকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তৎকালীন সেনা কর্মকর্তারা। কিন্তু সেই অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি সাফ বলে দিয়েছিলেন, ‘রাজনীতি আমার কাজ নয়,

আমার কাজ যেটা মানুষের কল্যাণ, সেটা আমি করছি।’ কিন্তু এবার তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারলেন না। ‘না’ বলতে পারলেন না। এর প্রধান কারণ হলো—তারুণ্যের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং তারুণ্যের প্রতি তাঁর বিশ্বাস। আর তরুণদের এই বিজয়কে

চূড়ান্ত বন্দরে নেওয়ার জন্য অভিভাবকের দায়িত্ব নিলেন তিনি। ৮ আগস্ট বিমানবন্দরে নেমেই তিনি সরাসরি বললেন, ‘তরুণদের মতামত নিতে হবে এবং সব কর্মকাণ্ডে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের

কেন্দ্রে থাকবে তরুণরা।’ মূলত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগ্রহের কারণেই উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তরুণদের। এ নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছেন বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।

রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে তারুণ্যর অবস্থান বিশ্বের জন্য এক অনন্য উদাহরণ। এটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নয়, বরং সারা জীবন তিনি যে বিশ্বাস এবং চিন্তাকে লালন করেছেন, তারই প্রায়োগিক রূপ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারা জীবন

তারুণ্যের শক্তিতে বিশ্বাস করেছেন। তরুণদের ওপর নির্ভর করতে চেয়েছেন। তিনি তাঁর বক্তৃতাগুলোতে বলেছেন, তরুণরা এই পৃথিবীকে বদলে দেবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি কথা সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি সব সময় বলে থাকেন, ‘আমাদের

চিন্তা-ভাবনাগুলো সেকেলে প্রচলিত, কিন্তু তরুণরা নতুন ভাবনা নিয়ে আসে, নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসে এবং সেটি পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে।’ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কর্মযজ্ঞে তরুণদের প্রতি রয়েছে এক ধরনের নির্ভরতা এবং অগাধ বিশ্বাস।

তিনি তরুণদের সম্মান দেন। তাঁদের চিন্তা-ভাবনাগুলো অনুধাবন করেন। তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেন। একটি নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানান। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রেখেছেন তরুণদের। তিনি সব সময় বিশ্বাস করেন, ‘তরুণরাই

পারেন, তরুণরাই পারবেন।’ আর এ কারণেই তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্ব তারুণ্যের কণ্ঠস্বর। কারণ তিনি তরুণদের ভাষা পড়তে পারেন, তাঁদের চিন্তাকে মূল্যায়ন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণরা জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞজন এবং সমাজের বিভিন্ন

ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনতে চান নানা উপলক্ষে। আর সেই আগ্রহের তালিকায় সবার ওপরে আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্বের ৬০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সামাজিক ব্যবসা ক্লাব রয়েছে। বিশ্বের এমন কোনো প্রান্ত নেই, যেখানে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বক্তব্য দেননি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে আচার্য পদে সম্মানিত করা হয়েছে। বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ভিজিটিং প্রফেসর। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে তরুণদের আইকন, বিশ্ব তরুণদের নেতা, তার প্রমাণ পাওয়া

যায় বিশ্বে চার হাজারেরও বেশি সামাজিক ব্যবসার ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে, যা তরুণদের দ্বারাই পরিচালিত। মূলত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম থেকে সামাজিক ব্যবসা, সামাজিক ব্যবসা থেকে ‘তিন শূন্য তত্ত্ব’ সবই তরুণদের ঘিরে।

১৯৭৪ সালে যখন তিনি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, তখন তিনি তরুণ ছিলেন এবং নিজের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। আমরা যদি গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, এখানে তারুণ্যের উদ্দীপনা এবং তারুণ্যের স্ফুরণ।

তরুণরাই সৃজনশীল, তাঁরা নতুন ভাবনা ভাবতে পারেন, তাঁরা বৃত্তের বাইরে গিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের জঞ্জাল, আবর্জনা পরিষ্কার করতে পারেন। এ জন্যই তরুণদের রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্বে আনার পক্ষে ড. ইউনূস।

ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা কার্যক্রম মূলত তরুণনির্ভর। একটি কথা শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ সব সময় বলেন, তা হলো—‘তরুণরা চাকরি খুঁজবে না, তারা চাকরি দেবে। তারা একেকজন উদ্যোক্তা হবে।’ এই উদ্যোক্তা হওয়ার তত্ত্ব এবং উদ্যোক্তার মাধ্যমে সামাজিক ব্যবসার বিকাশই যে বিশ্বের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে তা আজ সবাই স্বীকার করছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চিন্তা-ভাবনা সুদূরপ্রসারী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। যার জন্য সাদা চোখে এই ভাবনাগুলো বোঝা যায় না। ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন, তারুণ্যের কর্মশক্তি, তাঁদের উদ্দীপনা, তাঁদের সাহস এবং প্রবীণদের অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একটি সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণ সম্ভব। সেই সুন্দর পৃথিবীর জন্য তিনি স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন যাত্রায় তিনি একজন বীর লড়াকু যোদ্ধা। এই লড়াইয়ে তিনি অনেক বিজয় অর্জন করেছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের তরুণসমাজ এখন নানাভাবে হতাশাগ্রস্ত।

কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেন এ ব্যাপারে অনবদ্য সুযোগ পেয়েছেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর বারবার তরুণদের উদ্দীপ্ত করছেন, তরুণদের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের মতামতকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত করেছেন। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী জায়গায় এনেছেন তরুণদের। আমরা এখন অনেক কিছুই নতুন দেখছি। নতুনকে গ্রহণ করতে আমাদের এক ধরনের অনভ্যস্ততা থাকে, থাকে অনীহা। কিন্তু এটিই হবে আগামীর বাংলাদেশের ভিত্তি। অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের সৃজনশীলতার মেলবন্ধনই নতুন করে বাংলাদেশ বিনির্মাণ হচ্ছে সবার অলক্ষ্যে। এর ফল আমরা পাব আরো পরে।

ড. ইউনূসের নিজের কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায় নেই। কিন্তু তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে গেলে তারুণ্যের সৃষ্টি সুখের উল্লাস প্রয়োজন। আর এ কারণেই তরুণদের রাজনৈতিক দলের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। বয়সের ব্যারিকেড উপড়ে ফেলে তরুণদের অনুধাবন করা এবং তরুণদের হৃদস্পন্দন বুঝতে পারা একটি অনন্য যোগ্যতা। নতুন চিন্তা, নতুন পরিকল্পনাকে যাঁরা স্বাগত জানাতে পারেন, পরিবর্তনে যাঁরা ভয় পান না, তাঁরাই আধুনিক অগ্রসর মানুষ। ড. ইউনূস তেমনি একজন অগ্রসর মানুষ। তিনি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে সব সময় আগ্রহী। তরুণরা সব সময় পথ দেখান। আমরা যদি বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন এবং চব্বিশের বিপ্লব—সবই তারুণ্যের জয়গাথা। কাজেই তরুণরা যে পারেন সেটি নতুন করে পরীক্ষার কিছুই নেই। বিশ্বকে বদলে দিতে পারেন তরুণরা। কিন্তু তাঁদের দিতে হবে সেই সুযোগ। সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার এক পথপ্রদর্শক হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর এ কারণেই সারা বিশ্বে তরুণরা যখন এক আদর্শ হাতড়ে বেড়ান, তাঁদেরকে যখন কেউ আশাবাদী করে না, ভরসা দেয় না, তাঁদের দমিয়ে রাখতে চায়, ঠিক সে সময় একটি মুখের প্রতিছব্বি তাঁদের উদ্বেলিত করে। আর তিনি হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যিনি জীবনভর তারুণ্যের অর্গল মুক্তির গান গেয়ে যাচ্ছেন। তরুণদের মেধা, চিন্তা ও কর্মশক্তিতে যাঁর আস্থা সব সময়। আর সে কারণেই তিনি এখন বিশ্ব তারুণ্যের কণ্ঠস্বর, তারুণ্যের বিশ্বনেতা। বাংলাদেশে তরুণরা আজ চালকের আসনে। সামনে এটিই হবে বিশ্ব মডেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *