
সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার নিয়ে প্রতিবেদনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— সম্ভবত বেআইনি বল প্রয়োগ এবং বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশেষ করে র্যাবের কালো রঙের হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল, যা ছিল এক ধরনের ভয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
ওএইচসিএইচআর-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিক্ষোভকারীদের শায়েস্তা করার জন্য এবং তাদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে আরও বেশি হেলিকপ্টার মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ওই সময় র্যাব হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার কার্যক্রম চালায়। ওএইচসিএইচআরকে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, মিরপুরে (১৮ জুলাই), মহাখালীতে (১৮ জুলাই), ধানমন্ডিতে
(১৮ ও ১৯ জুলাই), বাড্ডায় (১৯ জুলাই), মোহাম্মদপুরে (১৯ জুলাই), রামপুরায় (১৯ জুলাই), শাহবাগে (১৯ জুলাই), বসুন্ধরায় (১৯ জুলাই, ২ ও ৩ আগস্ট),
গাজীপুরে (২০ জুলাই) এবং যাত্রাবাড়ীতে (২০ ও ২১ জুলাই) র্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর বারবার কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয়। সেই সঙ্গে ১৮ জুলাই সাউন্ড গ্রেনেডও ছোড়া হয় রামপুরায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও বলেছেন, ১৯ ও ২০ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল ও শটগান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী গুলিও ছুড়তে দেখা গেছে।
তথ্য অনুসন্ধানী দলের কাছে দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, হেলিকপ্টার থেকে বাড্ডা, বসুন্ধরা, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর এবং রামপুরা এলাকায় গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।
ওএইচসিএইচআর এই প্রতিবেদনে বলেছে, হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক গুরুতর উদাহরণ। কোনো অবস্থাতেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর এমন সহিংস কার্যকলাপ গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও পুলিশ ও র্যাবের মহাপরিচালকরা হেলিকপ্টার থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন, তারা গুলি ছোড়ার বিষয়ে কোনও নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেননি।
প্রতিবেদনে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত হেলিকপ্টার থেকে একবারও রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়েনি। তবে, ওএইচসিএইচআর-এর তথ্য অনুসন্ধানী দল কিছু ভিডিও পেয়েছে, যেখানে হেলিকপ্টার থেকে গ্যাস শেল ছোড়ার দৃশ্য দেখা গেছে। এই শেলগুলো দূর থেকে রাইফেল বা শটগানের মতো দেখালেও, বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এগুলোর পেছনে সাদা ধোঁয়া রয়েছে, যা কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার প্রমাণ।
এছাড়া, র্যাব এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা কেবল কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করেছে, কিন্তু রাইফেল বা শটগান থেকে গুলি ছোড়ার বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে সময় এসব ঘটনা ঘটেছিল, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। ফলে, ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি, যা তদন্তে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওএইচসিএইচআর আরও জানায়, তাদের কাছে এমন কোনো ভিডিও নেই যা পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়া হয়েছিল। তবে, তদন্তকারীরা মনে করেন যে, গুলির আঘাত প্রাপ্ত কিছু আহত ব্যক্তি হয়তো হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলির শিকার হয়েছেন। এমনও হতে পারে যে, ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছিল, যা পরে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গায়ে আঘাত করেছে।
ওএইচসিএইচআর প্রতিবেদনটি জানায়, এই ধরনের ঘটনার ব্যাপারে আরও তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা জরুরি। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের যাদের এই সময়ে হেলিকপ্টারে দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে পুরো ঘটনার সঠিক তদন্ত করা যায়।