এবার জাতিসংঘের কাঠগড়ায় শেখ হাসিনা!

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৪০০ নিরস্ত্র মানুষকে। এর মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থী, নিরস্ত্র বিক্ষোভকীরা, নারী ও শিশু রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার মোট শিশু ১১৮। শতকরা হিসাবে যা ১২-১৩ শতাংশ। আহত হয়েছেন প্রায় ১২ হাজার। ৬৬ শতাংশই মিলিটারি রাইফেলের গুলিতে এবং ১২ শতাংশ শটগানের গুলিতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। প্রমাণ হয়েছে-ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এই নৃশংসতার পথ বেছে নিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার নির্দেশ দেন হাসিনা।

পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্যরাও। এটি ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধ। আন্দোলনকারীদের অনেকে প্রাথমিক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে এসব উঠে এসেছে। বুধবার প্রতিষ্ঠানটির জেনেভা কার্যালয় থেকে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।

পরে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের বিরোধিতার মুখেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এ উদ্দেশ্য হাসিলে তারা বিক্ষোভ দমনের কৌশল নিয়েছিল। এটা করতে গিয়েই নির্বিচারে হত্যা, গ্রেফতার, আটক ও নির্যাতন চালিয়েছে আন্দোলনকারীদের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘ওএইচসিএইচআর’কে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তদন্তের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আমন্ত্রণে সারা দিয়ে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনা তদন্তে স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পরিচালনা করে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার। তাদের প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

বলা হয়, এসব ঘটনায় নির্বিচারে হত্যার প্রমাণ মিলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কমিশন বিশ্বাসযোগ্যভাবে মনে করছে-সামরিক, আধাসামরিক এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তারা হতাহতদের হাসপাতালে চিকিৎসায় বাধা দিয়েছে। ভয় দেখিয়েছে চিকিৎসকদের। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্ণ স্বজ্ঞানে, সমন্বয় এবং নির্দেশনায় হয়েছে। শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা শাখার নেতৃত্ব ও সমন্বয়ে এসব ঘটে। সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তাদের সাক্ষ্য অনুসারে প্রধানমন্ত্রী তাদের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিতেন, নিয়মিত নজরদারি করতেন এবং রিপোর্ট পেতেন।

পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, ডিজিএফআই এবং গোয়েন্দা শাখা দ্বারা পরিচালিত অপারেশনের জন্য সরাসরি আদেশ জারি করা হয়। এসব বাহিনী প্রতিবাদকারী ও সাধারণ নাগরিকদের নির্বিচারে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা এবং আটকের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সরকারি ও বেসরকারি সূত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে ওএইচসিএইচআর মনে করছে, আন্দোলন চলাকালে ১৪০০ মানুষ নিহত হতে পারে। যাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী অস্ত্র, সামরিক রাইফেল এবং শটগানের গুলিতে মারা যায়।

হাজার হাজার আহত ব্যক্তি তাদের জীবন বদলে দেওয়ার মতো গুরুতর আঘাতের শিকার হয়েছেন। পুলিশ ও র‌্যাব তথ্য দিয়েছে, তারা ১১ হাজার ৭০০’র বেশি মানুষকে গ্রেফতার করেছ। পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও শিশুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এ সময় যারা নিহত হয়েছে, তাদের ১২-১৩ শতাংশই শিশু। শিশু হত্যা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পঙ্গু করা, নির্বিচারে গ্রেফতার এবং অমানবিক নির্যাতন চরম অপরাধ।

মানবাধিকার কমিশন মনে করে, বিক্ষোভ এবং ভিন্নমত দমনের কৌশল হিসাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। গুরুতর এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগজনক। কোন মাত্রার মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, তা মূল্যায়নে দেশীয় আইনে ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। প্রেক্ষাপট: সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল রেখে ৫ জুন রায় দেন উচ্চ আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকায় তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

এর সঙ্গে যোগ হয় বিগত সময়ে মানুষের নানা ধরনের ক্ষোভ। এ ক্ষোভের মূলে ছিল রাজনৈতিক ব্যর্থতা, রাষ্ট্রপরিচালনায় অদক্ষতা, শাসনব্যবস্থার ভঙ্গুরতা ও দুর্নীতি। অর্থনৈতিক বৈষম্য সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছিল। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অভাব জনগণের ক্ষোভকে আরও উসকে দিয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, পেশাগত এবং ধর্মীয় পটভ‚মি থেকে আসা হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল।

ছাত্র-জনতা অর্থপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানিয়েছিল। জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ দমন এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টায় সাবেক সরকার সহিংসতাকে অবলম্বন হিসাবে বেছে নেয়। শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক তৈরি হয়। সশস্ত্র হামলা করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা: প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সাবেক সরকার এবং আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কুশীলবরা সুসংহত হতে থাকে।

বিক্ষোভ দমনের প্রাথমিক চেষ্টা হিসাবে সরকারের মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ছাত্রলীগকে উৎসাহিত করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং এর আশপাশে ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর ছাত্রলীগ লাঠি, ধারালো অস্ত্র এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে। শিক্ষার্থীরা এ সময় কখনো কখনো আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। সরকার এরপর আরও গুরুতর সহিংসতার পথ বেছে নেয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন করে পুলিশ, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি অংশ সশস্ত্র অবস্থায় সমন্বিতভাবে শক্তি প্রয়োগ করে। এভাবেই তারা শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি বড় বিক্ষোভ।

যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন: এসব ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সাধারণ বিক্ষোভ এবং ঢাকা ও অন্যান্য শহরে সম্পূর্ণ বন্ধের ডাক দেয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামী এতে সমর্থন করে। এর প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন সরকার বিক্ষোভকারী এবং প্রতিবাদী সংগঠকদের বিরুদ্ধে আরও সহিংস হয়ে ওঠে। এতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তির নিরাপত্তা লাভের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং পুলিশের হেলিকপ্টার আকাশ থেকে বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। পুলিশ, র‌্যাব এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মাঠে সামরিক রাইফেল এবং লোড করা শটগানের প্রাণঘাতী ছররা গুলি ছুড়ে। সেই সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে।

বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কেউ কেউ রাস্তা বন্ধ এবং কিছু স্থাপনা ভাঙচুরের চেষ্টা করে। কিন্তু তখন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলে আসছিল। এ ধরনের হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য কিছু বিক্ষোভকারী পালাক্রমে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠিসোঁটা ব্যবহার করে।

এ ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভকারীদের কিছু অংশ সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। যাদের বেশির ভাগ সরকারি ভবন, পরিবহণ অবকাঠামো এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী জোরদার করার নির্দেশ দেয়। ১৯ জুলাই থেকে বিক্ষোভ শেষ হওয়া পর্যন্ত বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ ঢাকা এবং অন্যত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। এ কারণে প্রতিবাদ কাভার করতে আসা সাংবাদিকসহ অনেকে বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং আহত হন।

২০ ও ২১ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের সময় পুলিশ এবং র‌্যাব গুলি ছোড়ার পূর্ণ ছাড়পত্র পায়। এতে নিহত ও আহতের ঘটনা ঘটে। জুলাইয়ের শেষদিকে সেনাবাহিনীও ব্যাপক অভিযানে অংশ নেয়। ওই সময়ে পুলিশ ও র‌্যাব গণবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে নির্বিচারে বিপুলসংখ্যক মানুষকে গ্রেফতার করে। কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর খুব কাছ থেকে গুলি ছোড়ে।

পুলিশ এবং আধা-সামরিক বাহিনী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস পথ অবলম্বন করেও তাদের দমাতে পারেনি। উলটো ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। ২০ জুলাই, সরকার সাধারণ কারফিউ জারি করে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ফাঁকা গুলি ছোড়ে, যা বিক্ষোভকারীদের নিহত বা গুরুতর আহত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেনি। কেবল একজন বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

সেনাপ্রধানের বৈঠক: প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আন্দোলন পরিস্থিতি নিয়ে ৩ আগস্ট সেনা অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাবাহিনীর প্রধান। বৈঠকে বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ প্রত্যাখ্যানের জন্য চাপ দেন জুনিয়র অফিসাররা। তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানান।

এরপরও সেনাবাহিনী আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের প্রতিরক্ষা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আরও সহিংস হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা পালটা আক্রমণের আশঙ্কা ছাড়াই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের অনুমতি পায়।

সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা যে ঢাকা মার্চের ডাক দেয়, তা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে থামানোর জন্য সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশকে একটি সরকারি পরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুসারে পুলিশ অনেক বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করে; কিন্তু সেনাবাহিনী ও বিজিবি বৃহৎ অর্থে নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে বিক্ষোভকারীরা নির্বিঘ্নে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা ও মানবাধিবার লঙ্ঘন: এ আন্দোলন দমনের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা শাখা ডিবি, অন্যান্য বাহিনীর বিশেষ শাখা এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসিইউ)।

তারা গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে নজরদারির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য এক সংস্থা থেকে আরেক সংস্থার সঙ্গে শেয়ার করে। এর মাধ্যমে জুলাইয়ের শেষের দিকে ব্যাপক হারে নির্বিচারে গ্রেফতারের পক্ষে প্রচারণা চালায়। গোয়েন্দা শাখা বন্দিদের কাছ থেকে তথ্য ও স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নিয়মিত ও নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। সিটিটিসির সদর দপ্তর শিশুসহ নির্বিচারে আটক ব্যক্তিদের বন্দিস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। গোয়েন্দা শাখা এবং ডিজিএফআই যৌথভাবে ছাত্রনেতাদের সেখানে অপহরণ ও আটক করে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন থেকে সরে আসতে চাপ দেয়।

ডিজিএফআই, এনএসআই এবং গোয়েন্দা শাখার লোকজন আহতদের জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সেবায় বাধাগ্রস্ত করে, প্রায়ই হাসপাতালে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ, আহত ব্যক্তিদের গ্রেফতার এবং চিকিৎসাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। এ পরিস্থিতি আইন সহায়তাকারী কর্তৃপক্ষ বা বিচার বিভাগ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি যাতে নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের ঘটনা এবং অনুশীলনগুলো বন্ধ করা যায়। এ ধরনের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও গুরুতর মানবধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা চেপে রাখার পক্ষে কাজ করে।

এনটিএমসি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে কাজ করে। এতে বিক্ষোভকারীরা কর্মসূচি সংগঠিত করতে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবহারের সুযোগ হারায়। সহিংসতা সম্পর্কিত তথ্য ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আদান-প্রদানে জনগণের অধিকার সংকুচিত করা হয়।

একই সঙ্গে ডিজিএফআই, এনএসআই এবং র‌্যাব গণবিক্ষোভ এবং তাদের সহিংসতা দমন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট না করার জন্য মিডিয়ার ওপর চাপ দেয়। ডিজিএফআই পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়ে ভিকটিম, তাদের পরিবার এবং আইনজীবীদের নীরব হওয়ার ব্যাপারে ভয় দেখাতে থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওএইচসিএইচআর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে যে পুলিশ, আধা-সামরিক, সামরিক এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িতরা নিয়মিতভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্ণজ্ঞান, সমন্বয় এবং নির্দেশনার ভিত্তিতে এ সহিংসতা ঘটানো হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা শাখার তৎপরতাগুলো সমন্বয় করতেন এবং নেতৃত্ব দিতেন।

উভয় পক্ষ একাধিক সূত্র থেকে বাস্তবে কী ঘটছে, সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিবেদন পেতেন। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য অনুসারে, ২১ জুলাই এবং আগস্টের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন সরবরাহ করতেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিজিবি, র‌্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ এবং গোয়েন্দা শাখার দ্বারা পরিচালিত কার্যক্রমের অনুমোদন ও নির্দেশ জারি করে। এসব বাহিনী প্রতিবাদকারী ও সাধারণ নাগরিকদের নির্বিচারে বিচারবহিভর্‚ত হত্যা এবং আটকের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের কর্র্মীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানি: বিক্ষোভের সময় অগ্রভাগে থাকার কারণে মেয়েরাও নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা হামলার শিকার হন। তারা বিশেষভাবে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়। যার মধ্যে রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা, ধর্ষণের হুমকি এবং কিছু নথিভুক্ত ঘটনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত যৌন নির্যাতন। ওএইচসিএইচআর প্রতিশোধমূলক ঘটনা হিসাবে যৌন সহিংসতা এবং ধর্ষণের হুমকি সম্পর্কিত অভিযোগ পেয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতা: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পাশাপাশি নিয়মিত আদালতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকার স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছে। প্রতিশোধমূলক সহিংসতাসহ অন্যান্য অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা এখনো দায়মুক্তি ভোগ করছে। হত্যাকাণ্ডের ৬৬ শতাংশ মিলিটারি রাইফেলের গুলিতে : আন্দোলনে নিহতদের ৭৮ শতাংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। এর মধ্যে আবার ৬৬ শতাংশ মিলিটারি রাইফেলের গুলিতে, ১২ শতাংশ শটগানে। আবার শটগানের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ মেটাল শটগান।

২ শতাংশ নিহিত পিস্তলের গুলিতে এবং ২০ শতাংশ অন্যান্যভাবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, পুলিশ ও আনসার ভিডিপি বাহিনী শটগান ব্যবহার করে। আবার নিহত অনেকের শরীরে পাওয়া বুলেটের আঘাতের ধরন থেকে বোঝা যায়, তারা ৭.৬২৩৯ এমএম মাপের সামরিক মানের প্রাণঘাতী গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এই অস্ত্র বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি তৈরি করে। অন্যদিকে ৭.৬২ এমএম মিমি ক্যালিবারের গুলি ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। এগুলো সামরিক বাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়। যা সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র‌্যাব ব্যবহার করে।

হাসপাতাল থেকে মরদেহ লুকানো : কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ হত্যাকাণ্ড গোপন করার জন্য হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে লুকিয়ে রাখে। এর মধ্যে কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মরদেহের গুলির চিহ্ন সরিয়ে কোনো রেকর্ড ছাড়াই পুলিশের কাছে সরবরাহ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

যেভাবে রিপোর্ট তৈরি করা হয় : এই প্রতিবেদন তৈরিতে ২৩০ জন বাংলাদেশির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকার, নিরাপত্তা বিভাগ এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তাদের আরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ঘটনাসংশ্লিষ্ট সরেজমিন অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন অনেক সাবেক এবং বর্তমান সিনিয়র কর্মকর্তারা রয়েছেন। তথ্য-উপাত্তগুলোর সত্যতা ভিডিও এবং ফটো, মেডিকেল ফরেনসিক বিশ্লেষণ, অস্ত্র বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য তথ্যবিশ্লেষণ সাপেক্ষে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *