থেমে গেছে যুদ্ধ। আর নেই ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার মুহুর্মুহু শব্দ। চারিদিকে আছে শুধু ধ্বংসের স্তূপ। যুদ্ধ বন্ধ হলেও স্বস্তির সঙ্গে এখনো আছে অনিশ্চয়তার ছাপ। গভীর ক্লান্তিতে দাদুর কোলে বসে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে ১০ বছরের আমর আল-হিন্দি। একেবারে স্থির, শান্ত, যেন একটা ঘন পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। বেঁচে থাকার আনন্দের মাঝেও তার চোখেমুখে শোকের ছায়া।
হঠাৎ বিবিসির প্রতিবেদকের দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করে তার বড় ভাই আলীর কথা। বলতে বলতেই চোখ থেকে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল আমরের। মায়াময় চোখের গভীরতা দিয়ে আমর বলছিল, ‘আমি আলীর মতো হতে চাই।
সে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। আমি আমার মৃত ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’ বিবিসি। গত বছর কোনো এক বিকালে ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায় গাজার বাইত লাহিয়ার একটি ভবন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে একটি
পরিবার। বাবা, মা ও ভাইবোন সবাই নিহত হন। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কেবল একা বেঁচে ছিল আমর। হামলার পরপরই তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। চারপাশে কেবল আর্তনাদ-হাহাকার, রোনাজারি আর রক্তাক্ত মানুষের মিছিল।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমর বারবার জানতে চায় তার ভাই শরীফের কথা। আমর বলছিল, ‘শরীফ কোথায়?’ পাশে থাকা নার্স সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘শরীফ ঠিক আছে। আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব।’
কিন্তু শরীফকে আর ফিরে পায়নি আমর। খুঁজে পায়নি তার আরেক ভাই আলী, বোন আসিল ও মা-বাবাকেও। একটি হামলায় শেষ হয়ে গেছে পুরো পরিবার। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর বিবিসি আমরের খোঁজ নিতে যায়।
সে সময় আমর তার দাদা-দাদির কাছে ছিল। এই আমরই এখন তাদের শেষ আশ্রয়। আমরের বেঁচে থাকার আনন্দের মাঝেও লুকিয়ে আছে এক গভীর ক্ষত। আমরের পায়ের তিনটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে।
তারপরও সে হাঁটার চেষ্টা করছে ধীরে ধীরে। আমর তার দাদুর কোলে বসে আলীর কথা বলে। আলী ডাক্তার হতে চেয়েছিল। সে জর্ডানে গিয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখত। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় আমর। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল।
এরপর আবারও বলছিল, আমি আলীর মতো হতে চাই। তার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই, জর্ডানে গিয়ে ডাক্তার হতে চাই। কান্নায় ভেঙে পড়া আমরের দাদা তৎক্ষণাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বললেন, ‘বাবা, তোমার কিছু হবে না।
’ এক হাতে বুক চাপড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন আমরের দাদা। গাজা যুদ্ধ কেবল ভূখণ্ডের দখলই কেড়ে নেয়নি, জীবনের স্বপ্ন, ভালোবাসাকেও ছিনিয়ে নিয়েছে। কিছু যুদ্ধ হয়তো অস্ত্রের শব্দে থেমে যায়। কিন্তু কিছু যুদ্ধ থেকে যায় বেঁচে থাকা মানুষদের ভেতর। অনেক দিন ধরে। হয়তো সারা জীবন।