বিমানবন্দরে মারামারি: যে কারনে সব দোষ পড়ল প্রবাসী কাঁধেই

নরওয়ে প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাঈদ উদ্দিন বুধবার রাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশে ফেরেন। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তিনি। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে বিমানবন্দরের

নিরাপত্তকর্মীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা এবং একপর্যায়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে যান। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজেও এই দৃশ্য ধরা পড়েছে। পরে প্রবাসী যাত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়। শেষপর্যন্ত বিমানবন্দরের ভ্রাম্যমাণ আদালতে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়া পান সেই যাত্রী।

এ ঘটনায় সুবিচার পাননি দাবি করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন প্রবাসীর স্বজনরা। এদিকে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী কোনো যাত্রীর গায়ে হাত দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে জানিয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পরিচালনা পর্ষদের সাবেক এক সদস্য ।

ভুক্তভোগী সাঈদ উদ্দিনের ভাগনে মুজাহিদ হোসেন রায়হান সমকালকে বলেন, নরওয়ের রাজধানী অসলোতে পরিবার নিয়ে থাকেন মামা। তিনি সেখানে গাড়ির ব্যবসা করেন। বুধবার রাতে তিনি স্ত্রী জান্নাতুল নাঈম ইপসা, বড়ভাই মহিউদ্দিন বিপ্লব, বাবা

গিয়াস উদ্দিন ও মা মনোয়ারা বেগম শাহজালাল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। গিয়াস বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে টার্মিনাল–২ এর ক্যানোপিতে দাঁড়িয়েছিলেন। ছেলের বের হতে দেরি দেখে তিনি দরজা থেকে উঁকি দিচ্ছিলেন। এ সময় তাকে বাধা দেন ও সরে যেতে বলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিমান বাহিনীর এক সদস্য। গিয়াস তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এক ফ্লাইটেই তারা সবাই এসেছেন, ছেলে এখনও বের হয়নি, তাই দেখার চেষ্টা করছেন।

তবে নিরাপত্তাকর্মী জানান, পাসপোর্ট ছাড়া কেউ সেখানে অবস্থান করতে পারবেন না। গিয়াস জানান, তাঁর পাসপোর্ট গাড়িতে রাখা আছে। তিনি ভেতরে যাবেন না। এ নিয়ে বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে তাকে ধাক্কা দেন ওই নিরাপত্তাকর্মী। তখন অদূরে থাকা

সাঈদ এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, কেন আমার বাবার গায়ে হাত দিয়েছেন? এ নিয়ে আবারও বাকবিতন্ডা এবং একপর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। তখন সেখানে কর্তব্যরত কয়েকজন মিলে সাঈদকে মেরে রক্তাক্ত করেন। তাঁর চোখ–ঠোঁটসহ মুখমন্ডলে গুরুতর জখম হয়েছে। তাকে মারধর থেকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী ও মা আহত হন।

রায়হান দাবি করেন, তার মামাকে মেরে রক্তাক্ত করার পর উল্টো তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা আদায় করা হয়। ওই ঘটনার পর তাকে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারুক সুফিয়ানের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে তাকে সরকারি কর্মচারীকে মারধর করার অপরাধ স্বীকার করে নিতে বলা হয়।

তবে সাঈদ বলেন, আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। আমাকেই বিনাকারণে মারধর করা হয়েছে। এরপরও তাকে দোষ স্বীকার করতে চাপ দেওয়া হয়। তাকে বলা হয়, এক মাসের জন্য দেশে এসেছেন, দোষ স্বীকার না করলে তিন বছরেও ফিরতে পারবেন

না। তখন বড়ভাই মহিউদ্দিন তাকে অনুরোধ করেন দোষ স্বীকার করতে। তিনি ভাইকে বলেন, এটা নরওয়ে না, এখানে এমনই হয়। সবাই কষ্ট পাচ্ছে, তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেল। পরে পরিবারের সবার অনুরোধে সাঈদ দোষ স্বীকার করলে তাকে দণ্ডবিধির ১৮৯ ধারায় পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। শেষে তিনি গ্রামের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সোনাখালীতে চলে যান।

রায়হান বলেন, ওই ঘটনার পর মামা (সাঈদ) যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি এ নিয়ে কারও সঙ্গে আর কথা বলতে চাইছেন না। স্বজনদের শুধু বলেছেন, তিনি সুবিচার পাননি। সুস্থ হয়ে দুই–একদিনের মধ্যে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানাবেন।

এদিকে ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সাঈদ বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক বিমানবাহিনী সদস্যকে ধাক্কা দেন। পরে তাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। তাদের থামানোর চেষ্টা করেন বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এভিয়েশন সিকিউরিটির (এভসেক) সদস্যরা।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, সংঘর্ষের পর ওই প্রবাসীর চোখ ও ঠোঁট জখম হয়েছে। তাঁর ধাক্কায় বিমান বাহিনীর সদস্য কোহিনূরও আহত হন। তাঁর চোখ ফুলে গেছে। ভিডিওতে কোহিনূরকে বলতে শোনা যায়, ‘কাজটা ভালো করেন নাই। আপনি কেন ধাক্কা দিলেন?’ জবাবে সাঈদ বলেন, ‘আপনি ওনাকে (গিয়াস উদ্দিন) ধরেন নাই? আপনারা পাঁচজন-ছয়জন মিলে মারছেন।’

যাত্রীর দোষ দেখছে কর্তৃপক্ষ
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম একটি লিখিত বক্তব্য পাঠান। তাতে বলা হয়েছে, বুধবার আনুমানিক রাত সোয়া ৯টার দিকে বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক আগমনী ক্যানোপি–২ এর সামনে দু’জন যাত্রী একজন নিরাপত্তাকর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও

প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, পাঁচজন যাত্রীর একটি দল বিমানবন্দরের কার্যক্রম শেষ করে বের হওয়ার সময় তাদের একজন ট্রলিসহ ক্যানোপি–২ এর ফটকের সামনে অবস্থান করলে অন্য যাত্রীদের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী তাকে কিছুটা সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি তাতে কর্ণপাত না করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পর নিরাপত্তাকর্মী আবারও তাকে

সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি প্রচন্ড রেগে অকথ্য ও অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। তখন সেখানে নিয়োজিত আরেক নিরাপত্তাকর্মী যাত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা চালান। একপর্যায়ে ওই যাত্রীর ছেলে (একই ফ্লাইটের যাত্রী, তিনি পেছনে ছিলেন) ঘটনাস্থলে এসে বিমান বাহিনীর নিরাপত্তাকর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন। যাত্রীরা নিরাপত্তাকর্মীকে কিলঘুষি মারা শুরু করলে তাদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি হয় এবং ওই নিরাপত্তাকর্মী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আনসার ও এভসেক সদস্যরা এগিয়ে গিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের যাত্রীর হাত থেকে মুক্ত করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *