বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেই সীমান্তে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে বিএসএফ। নির্বিচারে বাংলাদেশি হ’ত্যা ও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে আগ্রাসী অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এদিকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। কখনো কখনো বিজিবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিচ্ছেন স্থানীয়রাও। গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধের নামে নির্বিচারে বাংলাদেশি হ’ত্যা করে যাচ্ছে বিএসএফ।
তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে এই সাহস দেখিয়েছে প্রতিবেশী দেশটির সীমান্তরক্ষীরা। বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও তাদের সেই প্রাকটিস থেকে এখনো সরে আসতে পারেনি বিএসএফ। সর্বশেষ গতকাল বুধবার সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মাছিমপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন সাইদুল ইসলাম (২৩) নামের এক বাংলাদেশি যুবক। অনেক সময় বিএসএফ গুলি করে লাশ নিয়ে যায় সীমান্তের ওপারে।
ভারত গুলিতে নিহতদের চোরাকারবারি দাবি করলেও দেখা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই স্থানীয় কৃষক বা অন্য পেশাজীবী। এসব বিষয়ে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশিদের হ’ত্যা বন্ধে কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিজিবির কঠোর অবস্থানের সুফলও মিলতে শুরু করেছে। সম্প্রতি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ভারতের দখলে থাকা কোদলা নদীর পাঁচ কিলোমিটার এলাকা উদ্ধার করেছে বিজিবি। বাহিনীটি জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকেই কোদলা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ওই অংশ ভারতের বিএসএফ দখল করে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
প্রথমে বিভিন্ন নথিপত্র স্থানীয় প্রশাসন ও মানচিত্র থেকে নদীটির প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে বিএসএফের অবৈধ আধিপত্য বিস্তারের বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পরে ৫৮ বিজিবির সদস্যরা সাহসিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কোদালিয়া নদী নিজেদের আয়ত্বে আনতে সক্ষম হয়। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ সীমান্তে বিএসএফের কাঁটাতার নির্মাণ নিয়ে সীমান্তে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। দুই সীমান্তেই বিজিবির সঙ্গে স্থানীয়রা যুক্ত হয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আগ্রাসী উদ্যোগ বন্ধ করে দেয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার বস্তাবর সীমান্তে গতকাল বুধবার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিএসএফ। তবে বিজিবির বাধায় কাজ বন্ধ করে পিছু হটে বিএসএফ। এ বিষয়ে নওগাঁর ১৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল জানান, বস্তাবর সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৬০০ গজের মধ্যে দুই দেশের কোনো বেড়া নেই। সকালে হঠাৎ বিএসএফের একটি দল ওই সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দিতে আসে। আইন অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্ত পিলার থেকে দেড়শ গজের মধ্যে ফসল চাষ ছাড়া স্থায়ী কোনো স্থাপনা কিংবা বেড়া দিতে পারবে না।
এটি দুই দেশের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু বিএসএফ সদস্যরা আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে বেড়া দিতে আসার খবর পেয়ে বিজিবি সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। এ সময় কাজ না করেই ফিরে যায় বিএসএফ সদস্যরা। তিনি আরো জানান, এ বিষয়ে উভয় বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করা হবে। সীমান্তের এমন পরিস্থিতিতে বিজিবি সবসময় সতর্ক আছে।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের ওপারে ভারতের সুখদেবপুর সীমান্তে বিএসএফের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে গতকাল বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে চৌকা সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
জানা গেছে, আনুমানিক ১০০ গজ ভারতের ভেতরে চৌকা মাঠ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য মাটি খননের কাজ শুরু করা হয়। ঘটনাটি জানতে পেরে বিজিবির চৌকা সীমান্তের টহল দল পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে সেই কাজে বাধা দেয়। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিতে বিএসএফ আবার মাটি খননের কাজ শুরু করে।
খবর পেয়ে বিজিবি গিয়ে তৎক্ষণাৎ বাধা দেয়। তবে বিএসএফ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় নির্মাণকাজ আবারও শুরু করে। এ সময় বাংলাদেশ সীমান্তের এপারেও স্থানীয়রা জড়ো হয়ে ভারতবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ৫৯ বিজিবির অধিনায়ক ও বিজিবির রাজশাহীর সেক্টর কমান্ডার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। পরে দুই বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিএসএফ অতিরিক্ত জনবল ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সরিয়ে নিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখে। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজিবি সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, বিজিবির সঙ্গে কোনো সমঝোতা ছাড়াই গত সোমবার বিএসএফের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ শুরু করা নিয়ে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সমঝোতা ছাড়া কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ বন্ধ থাকবে।