‘রাজপথে প্রথম আমি বুক পেতে দাঁড়াই, পরবর্তীতে ১৬ জুলাই আবু সাঈদ ভাই শহীদ হন’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসমন্বয়ক এবং গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘২০২৪ সালের ১১ জুলাই রাজপথে হাসিনার পুলিশের বুলেটের সামনে এই আন্দোলনে প্রথম আমি বুক পেতে দাঁড়াই। পরবর্তীতে ১৬ জুলাই আমাদের সহযোদ্ধা শহীদ আবু সাঈদ ভাই ঠিক একইভাবে বুক পেতে দেন, আর পুলিশের বুলেটে শহীদ হন।’

গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন গণমাধ্যমের একটি লাইভ ভিডিও নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেয়ার করেন রাফি। ভিডিওটি মূলত আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও ধাওয়া এবং পুলিশের সামনে খান তালাত মাহমুদ রাফির দুহাত প্রশস্ত করে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সেই দৃশ্যের।

এই লাইভ ভিডিও প্রতিবেদনটি শেয়ার করে রাফি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এদেশে ইতিহাস বিকৃত হয়, ইতিহাস বিস্তৃতও হয় আবার মাঝেমধ্যে ইতিহাস মুছেও যায়। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, এটা অন্তত আমার লেখা উচিত।’

অনেকেই ২০২৪ সালের ১১ জুলাইকে ‘স্বৈরাচার’ পতনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন মনে করেন বলে জানান রাফি। তিনি বলেন, ‘আবার সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে অনেকেই আমাকে গালাগালিও শুরু করে দিয়েছেন। আর এগুলো মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে অস্বীকার করতেও দ্বিধাবোধ করবে না গুটিকয়েক।’

পুলিশের সামনে রাফির বুক পেতে দেওয়ার ভিডিওটি নিয়ে অনেকে ট্রল করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, এতে করে ব্যাপারটাকে অনেকটাই সস্তা মনে হয়েছে। তবে এ নিয়ে আমার কোনোরকম দুঃখ, রাগ বা অভিযোগও নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে খানিকটা কষ্ট লাগে। যখন দেখি আমাদেরই সহযোদ্ধা, জুলাইয়ে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন করেছিলাম তারাও সেই বুলিংয়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। একেকজনের রাজনৈতিক মতাদর্শ একেক রকম থাকতে পারে, ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু আমরা জুলাইয়ে একই রাজপথে ছিলাম।’

১১ জুলাই পুলিশের সামনে দাঁড়ানো সেই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে রাফি লেখেন, ‘সেদিন আমরা চট্টগ্রামের কর্মসূচী চট্টগ্রাম বটতলী স্টেশনে ঘোষণা করি। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো স্টেশনে জড়ে হয়ে সেখান থেকে সুবিধা অনুযায়ী মুভ করবো। সেদিন রাজপথে আমাদের শিক্ষার্থীদের সংখ্যার চেয়ে পুলিশের সংখ্যা বেশি ছিলো। পুলিশ থেকে বারবার বলা হচ্ছিলো আমরা যেন রাজপথ না নামি।’

এরপর বিকেল ৪টার পরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কিছুটা বেড়ে ২০০-২৫০ জনের কাছাকাছি হলে তারা মুভ করা শুরু করেন উল্লেখ করে রাফি লেখেন, ‘কিন্তু সাথে সাথেই পুলিশের বাধা পেতে হয়। আমরা মুভ করা শুরু করলেই বটতলী পুরাতন স্টেশনের মুখে পুলিশ আমাদের বাধা দেয়। আমরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আবার মার্চ করা শুরু করি। টাইগারপাস মোড়ে গিয়ে দেখি অন্তত ৩শ থেকে ৪শ পুলিশের ব্যারিকেড।’

টাইগারপাসে প্রায় ৩০-৪০ মিনিট পুলিশের সাথে আমাদের বাকবিতণ্ডা হয় বলে জানান রাফি। তিনি লেখেন, ‘একপর্যায়ে আমাদের সামনের সারিতে থাকা বোনেরা বলে আপনারা মুভ না করলে আমরা একা মুভ করবো। বোনেদের কথায় আমরা সাহস পাই এবং পেছন থেকে ফোর্স করতেই ব্যারিকেড ভেঙে যায়। কিন্তু সেদিন পুলিশ ছেলে-মেয়ে দেখে নাই। যাকে পেয়েছে, তাকেই নির্মমভাবে মেরেছে।’

‘দৌড়ে দৌড়ে দুই নাম্বারের দিকে মার্চ করতে করতে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং পুলিশ আমাদের পেছনে ধাওয়া করতে করতে আসছিলো। রাস্তায় আমাদের সাথে অনেকেই মিছিলে যুক্ত হয়েছিলো। তবে মিছিলে সর্বোচ্চ ১০০ জন ছিলো। আমারা যখন প্রায় দুই নাম্বারের দিকে চলে আসি, তখন দেখি দুই নাম্বার থেকে পুলিশ সামনে থেকে অ্যাটাক দিচ্ছে, আর পেছনে তো ধাওয়া আছেই। আর হঠাৎ পুলিশ আমাদের মিছিলে লাঠিচার্জ শুরু করলো। সবাই যে যেভাবে পারে, প্রাণ নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলো। আমি আস্তে আস্তে দৌড়াচ্ছিলাম আর সবাইকে ডাকছিলাম। কিন্তু তখন দাঁড়ানোর মতো অবস্থা ছিলো না,’ যোগ করেন রাফি।

তিনি আরও লেখেন, “একপর্যায়ে মনে হলো কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। আর ১ নাম্বার গেটে ব্লকেড কর্মসূচিতে ‘প্রয়োজনে পেট্রোল দিয়ে নিজেকে জ্বালিয়ে দিবো কিন্তু দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বো না’ বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা রক্ষা করতে যখন দেখি পেছনে পুলিশ ছাড়া আর কেউ নাই, তখন আর কিছু না ভেবে দাঁড়িয়ে গেলাম।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *