সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতার অঢেল সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেল যুক্তরাষ্ট্রে

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে সম্পদ কিনেন তিনি। এই সম্পদ খুঁজে পেয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।

এর আগে তার বিরুদ্ধে দেশ থেকে অর্থপাচার করে যুক্তরাজ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কেনার অভিযোগ উঠে। তবে আওয়ামী লীগের এই নেতা কেবল যুক্তরাজ্যে নয়, জমি কিনেছেন যুক্তরাষ্ট্রেও।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ফ্লোরিডার ওকালা ন্যাশনাল ফরেস্টের পশ্চিম সীমান্তে ৫০ শতাংশের মতো (আধা একর) জমি কিনেছিলেন। এই জায়গা অরল্যান্ডো থেকে উত্তরে এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। এই ভূমি নিয়ে শিগগিরই আন্তর্জাতিক মামলা হতে পারে। এই জায়গা এখনো বনভূমির অংশ। সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি।

স্থানীয় মেরিয়ন কাউন্টির সম্পদ মূল্যায়নকারীর রেকর্ডে দেখা গেছে, এই জমি দুই দশক আগে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী কিনেছিলেন। জমিটি কেনা হয়েছিল ৪৮ হাজার ডলারের বিনিময়ে। এই জমি মূলত এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কিনেছিলেন।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জাবেদ ও তার নিকটাত্মীয়দের অন্তত ২৯৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে অর্জিত ৪৮২টি সম্পত্তি শনাক্ত করেছে। এগুলো কেনা হয়েছিল ১৯৯২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে। জাবেদের সম্পত্তিগুলোর মধ্যে—দুবাইয়ের বুরজ খলিফা জেলা এবং এর পাম জুমেইরা কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জের ফ্ল্যাট, লন্ডনের আশপাশের শহরগুলোর একাধিক ফ্ল্যাট। এর মধ্যে একটি দুই বেডের ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে লন্ডনের স্লাফ রেল স্টেশনের কাছে।

এসব সম্পত্তি কেনায় যে পরিমাণ অর্থপাচার করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে, সেগুলো এখন ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।

জাবেদ ২০২৩ সালে সংসদে ঘোষণা দেন তার ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ আছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তার সর্বশেষ ঘোষিত আয়কর রিটার্নে বলা হয়, তার কোনো বৈদেশিক আয় নেই। জাবেদ এবং তার কিছু আত্মীয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি একটি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে।

চুরি হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান মানসুরের ধারণা, আওয়ামী সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘এটা জনগণের টাকা, তারা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে এই টাকা প্রকাশ্য দিবালোকে নিয়ে গেছে।’

সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ আওয়ামী রেজিমের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ ধনকুবেরদের একজন। তার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘তিনি ভূমিমন্ত্রী ছিলেন এবং মনে হচ্ছে, তিনি জমি খুবই ভালোবাসেন।’

এফটির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জাবেদ এবং তার নিকটাত্মীয়রা এত বেশি সম্পত্তির মালিক যে, তাদের সব তথ্য সামনে আসেনি। এই পরিবারের মালিকানায় যুক্তরাজ্যে ৩১৫টি, দুবাইয়ে ১৪২টি, নিউইয়র্কে ১৬টি, ফ্লোরিডায় ৬টি এবং নিউজার্সিতে ৩টি সম্পত্তি আছে।

এফটি আরও শনাক্ত করেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের নজরে থাকা অন্যান্য বাংলাদেশি অভিজাত সিঙ্গাপুর এবং কানাডার মতো দেশে ৫৭৮ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি অর্জন করেছে।

অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হবে—অভিযুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে দেশে মামলা দায়ের করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য স্থানে আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক আইনিসহায়তার অনুরোধ প্রস্তুত করা, যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক মামলার পথ প্রশস্ত করবে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘যদি আমরা মনে করি যে, বিশ্বটা একসঙ্গে বসবাসকারী বন্ধুদের একটি কমিউনিটি এবং যদি আমার টাকা চুরি হয়ে আপনার দেশে জমা হয়, তাহলে আমি মনে করি, এটা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সাহায্য করার একটি বাধ্যবাধকতা আছে।’

এদিকে যুক্তরাজ্যে জাবেদের রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্যের আকার, সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী ও হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পত্তি গ্রহণের অভিযোগ অর্থনৈতিক অপরাধ এবং অবৈধ অর্থ প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রবিধানের শক্তি এবং ব্রিটিশ সরকারের নোংরা অর্থের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

ব্রিটিশ এফবিআই-খ্যাত ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি আয়োজিত যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বয় কেন্দ্র বলেছে, তারা ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে থাকা বড় দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের প্রচেষ্টায় সহায়তা করার সুযোগ খুঁজছে।’

এই বিষয়ে জানতে চেয়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি জবাব দেননি। তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও কিছু সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার অভিযোগ আছে। তিনি ই-মেইলে বলেছেন, তার নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ আলাদা এবং তিনি তার ক্রয়গুলো সঠিক ‘ডিউ ডিলিজেন্স’-এর মাধ্যমে সম্পন্ন করা বন্ধক এবং বাবার কাছ থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সংযোগ থাকায় পরিবারকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *