সেন্টমার্টিন নিয়ে খেলা শুরু?

সূর্য মধ্য আকাশে, সেন্ট মার্টিনের সমুদ্র ঝলমলে নীল বাতাসে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে, ঠিক যেমনটা ট্রাম্প পছন্দ করেন। ১৬০০ মাইল দূরে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে একদিন ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমেরিকা যেখানে যেতে চায়,

সেখানে যাবে; কেউ আটকাতে পারবে না।” আজ সেই কথারই প্রতিধ্বনি যেন বঙ্গোপসাগরের নীল জলে আয়নার মতো ভাসছে। তবে, সেন্ট মার্টিনের জেলেরা জানে না তাদের চারপাশের নির্জন জলরাশি নিয়ে কী খেলা চলছে।

বিশ্বের মানচিত্রে সেন্ট মার্টিন মাত্র একটি বিন্দু, কিন্তু এই ছোট্ট বিন্দুই এখন পরিণত হচ্ছে এক অদৃশ্য দাবার বোর্ডে, যেখানে চাল দিচ্ছে সুদূর ওয়াশিংটনের নীতি নির্ধারকরা। নানান বিশ্লেষণে উঠে আসছে, সুদূর মার্কিন অফিসিয়ালদের চোখ এখন এই ছোট্ট

দ্বীপের দিকে। এখানে যদি একদিন আমেরিকার পতাকা ওড়ে, তা শুধু একটি সামরিক ঘাটির গল্প হবে না, বরং এক নতুন ক্ষমতার বিন্যাসের ঘোষণা হয়ে উঠবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমেরিকার সেন্ট মার্টিনে আসতে চাওয়ার গল্প কি একদম বানোয়াট,

না কি যৌক্তিক হিসাব-নিকাশ আছে? বিশ্বে যা কিছু ঘটছে, তার বেশিরভাগই হয় আমেরিকার ইশারায়, অথবা কমপক্ষে তাদের নীরব সম্মতিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকা তার সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তিকে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত করেছে।

আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর, প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রয়েছে তাদের সামরিক ঘাঁটি। কিন্তু এক জায়গায় এখনো শূন্যতা রয়ে গেছে—বঙ্গোপসাগর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে বারবার গুঞ্জন উঠেছে যে,

সেন্ট মার্টিনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চলছে। যদি আমেরিকা এই ঘাঁটি তৈরি করতে পারে, তাহলে তারা তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে।

পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারবে। চীন মনে করে, ভবিষ্যতের শক্তির মূল চাবিকাঠি সামরিক নয়, বরং অর্থনৈতিক আধিপত্য। তারা “মেইড ইন চায়না” এবং “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” নীতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী

বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। তবে চীনের একটি দুর্বলতা রয়েছে—তাদের নিজস্ব জ্বালানি নেই। তারা ইরান থেকে বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস আমদানি করে, যা বঙ্গোপসাগর হয়ে রাখাইন ও পাকিস্তান হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

এই রুট নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, আমেরিকা চীনের অর্থনৈতিক প্রবাহে সরাসরি আঘাত হানতে পারবে। এই কারণেই আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য স্থাপন করতে চায়, এবং এর জন্য সেন্ট মার্টিন হতে পারে তাদের কৌশলগত ঘাঁটি।

বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখার জন্য আমেরিকা সবসময় চায় তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের এক ধাপ পেছনে রাখতে। বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী চীন এবং কিছুটা ভারত।

একজন মেধাবী ছাত্রের মতোই, আমেরিকা চায় না যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে ওভারটেক করুক। যদি কখনো চীন বা ভারত এগিয়ে যেতে থাকে, তবে অন্তত তাদের গতিকে বিলম্বিত করার জন্য যা যা করা দরকার, আমেরিকা তা করবে।

চীন ও ভারতকে দৌড়ে রাখার জন্য বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার উপস্থিতি অপরিহার্য। চীন এখন শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামরিকভাবেও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, এবং ভারতও কম যায় না,

বিশেষ করে মহাকাশ থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা খাতে বিশাল অগ্রগতি করছে। তাই, যদি চীন ও ভারতকে রুখতে হয়, তাহলে আমেরিকাকে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

বঙ্গোপসাগরে কোন শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি না থাকায় আমেরিকা এখানে পিছিয়ে আছে। বিশ্বজুড়ে ছড়ানো আমেরিকার শতাধিক ঘাটির মধ্যে বঙ্গোপসাগরে এখনো কোন শক্তিশালী উপস্থিতি নেই।

কিন্তু যদি কখনো চীন তাইওয়ান যুদ্ধ শুরু করে, তখন পরিস্থিতি বদলে যাবে। আমেরিকা সবসময় তাইওয়ানকে তাদের নিজস্ব স্বার্থের অংশ হিসেবে দেখে। তারা বিশ্বাস করে, চীন যদি তাইওয়ানের উপর আক্রমণ করে,

তবে সেটি সরাসরি আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হবে। বিশ্লেষকদের মতে, সেন্ট মার্টিন হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি আদর্শ সামরিক ঘাঁটি। এখান থেকে সহজেই দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।

বিশেষ করে তাইওয়ানের সাপোর্টে দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার উপস্থিতি থাকলেও, বঙ্গোপসাগর থেকে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে চীনের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।

এটি নিশ্চিত করবে যে, চীন যদি যুদ্ধের কথা ভাবতে যায়, তবে আমেরিকাও প্রস্তুত। ঢাকার নীতি নির্ধারকদের জন্য এখন একটা কঠিন সময়। একদিকে চীন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক, অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক মৈত্রী এবং আমেরিকার চাপ।

শেখ হাসিনার আমলে বিষয়টি নিয়ে তীব্র গুঞ্জন ছিল, তবে সরাসরি সিদ্ধান্ত আসেনি। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের পর বিষয়টি আবার সামনে এসেছে—আমেরিকা যদি ঘাঁটি করতে চায়,

বাংলাদেশ কি অনুমতি দেবে, নাকি চীন এর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করবে? সেন্ট মার্টিন এখনো নিঃশব্দ, কিন্তু তার চারপাশের জলরাশি আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হচ্ছে।

৯০ কিলোমিটার দূরের কক্সবাজারে, একজন আমেরিকান একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বসে আছেন, ম্যাপে সেন্ট মার্টিনের ওপর লাল দাগ টানছেন। হিসেব করছেন কৌশলের। তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে ব্রেকিং নিউজ: বঙ্গোপসাগরে অস্থিরতা, সেন্ট মার্টিন নিয়ে নতুন আলোচনা। একজন এনজিওর হয়ে কাজ করা এই আমেরিকান জানেন, আমেরিকা যা চায়, সেটাই হয়—সময় লাগলেও হয়।

বিশ্ব রাজনীতির দাবার বোর্ডে, সেন্ট মার্টিন কি শেষ পর্যন্ত আমেরিকার ঘাঁটি হয়ে উঠবে, নাকি এটি রয়ে যাবে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার শেষ সীমানা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *