
• নির্ধারিত দামের এক তৃতীয়াংশও দর ওঠেনি
• ১০ কোটি টাকার গাড়ি লাখ টাকায় নিতে আগ্রহ বিডারদের
• ১০টি গাড়ির নিলামে অংশ নেয়নি কেউ
• সাবেক এমপি মহুলের ভাই অংশ নিয়েছেন একটিতে
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বিলাসবহুল ২৪টি ল্যান্ডক্রুজার সম্প্রতি নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টম। অধিকাংশ গাড়িরই মেলেনি কাঙ্ক্ষিত দাম। কোনো কোনো গাড়ি কিনতে আবার কেউ আগ্রহই দেখায়নি। নিলামে অংশ নেওয়াদের মধ্যে আছেন গাড়ি আমদানিকারক সাবেক এমপির ভাইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
কাস্টম সূত্রে জানা যায়, জাপানে প্রস্তুত করা এসব গাড়ির মধ্যে ৩৩৪৬ সিসির ২১টি ২০২৪ সালের তৈরি, একটি ২০২২ সালের এবং ৩৩৪৫ সিসির দুটি ল্যান্ড ক্রুজারের তৈরি সাল ২০২৩। প্রতিটি গাড়ির মূল্য ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা নির্ধারণ করে কাস্টম। নিলামে নির্ধারিত দামের এক তৃতীয়াংশ দরও ওঠেনি। একটি গাড়ির সর্বোচ্চ দর ওঠে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। ১১ গাড়ি কেনার জন্য কেউই আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
২৪টি গাড়ির মধ্যে একটি গাড়ি রয়েছে ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুলের। তার গাড়িটি কেনার জন্য কেউ আগ্রহ না দেখালেও তার ছোট ভাই এম এ লতিফ জাহেদী প্রজ্জ্বল রংপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আসাদুজ্জামানের ৩৩৪৬ সিসির ল্যান্ড ক্রুজারটি কেনার আগ্রহ দেখান। নিজের প্রতিষ্ঠান ইজি সার্ভিসেস লিমিটেডের নামে ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দর হাঁকেন তিনি। মহুল ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বেও রয়েছেন।
কাস্টম সূত্র জানায়, সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামানের আমদানি করা গাড়িটির নিলামে আরও দুই ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান অংশ নেন। এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা দর হাঁকেন চট্টগ্রামের জামাল খান এলাকার মোহাম্মদ এয়াকুব চৌধুরী। পাশাপাশি দেশের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কেডিএস গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড গাড়িটির দর হাঁকে ৩০ লাখ টাকা।
নিলামে ওঠা বিলাসবহুল ল্যান্ডক্রজারগুলোর মধ্যে ৩৩৪৬ সিসির ২০২২ সালে তৈরি করা গাড়িটি আমদানি করেছিলেন প্রয়াত সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি ২০২২ সালের ১১তম জাতীয় সংসদের সদস্য থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। যে কারণে গাড়িটি বন্দর থেকে খালাস নেওয়ার সুযোগ হয়নি। ওই গাড়িটির নিলামেও কেউ অংশ নেননি।
নিলামে ডাকা অন্য গাড়িগুলোর মধ্যে ৩৩৪৬ সিসির ২০২৪ সালে তৈরি ২১ গাড়ি আমদানি করেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ঢাকা-১৭ আসনের মোহাম্মদ আলী আরাফাত, চট্টগ্রাম-১৫ আসনের স্বতন্ত্র এমপি ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মোতালেব, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের জান্নাত আরা হেনরী, গাইবান্ধা-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শাহ সরোয়ার কবির, বগুড়া-৫ আসনের মজিবর রহমান মজনু, খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসাইন, জামালপুর-৫ আসনের মো. আবুল কালাম আজাদ, নেত্রকোনা-৪ আসনের সাজ্জাদুল হাসান, গাজীপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান, ঢাকা-১৯ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম, ময়মনসিংহ-১১ আসনের মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ (স্বতন্ত্র), যশোর-২ আসনের মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুনু রেজা (আসন-১২), শাম্মি আহমেদ (আসন-১৭), নাট্য অভিনেত্রী তারানা হালিম (আসন-৩১), সানজিদা খানম (আসন-৩২) এবং নওগাঁ-৩ আসনের সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী।
শুল্কমুক্ত সুবিধার গাড়িগুলোতে কাঙ্ক্ষিত দর পাওয়া না গেলেও বেশ কয়েকটি গাড়িতে প্রয়োজনীয় দর উঠেছে। নিলামের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমবার নিলামে নির্ধারিত দরের ৬০ শতাংশ কিংবা তার বেশি দর উঠতে হবে। তবে দ্বিতীয় বারের নিলামে সেই শর্ত নেই। দ্বিতীয়বার নিলামে প্রথমবারের বেশি হলেই কাঙ্ক্ষিত দর হয়ে যাবে।-চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সহকারী কমিশনার (নিলাম) মো. সাকিব হোসেন
৩৩৪৫ সিসির ২০২৩ সালে তৈরি দুটি ল্যান্ডক্রুজার আমদানি করেন দুই স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ময়মনসিংহ-৭ আসনের এ বি এম আনিছুজ্জামান এবং নীলফামারী-৩ আসনের সাদ্দাম হোসেন পাভেল।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলামে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাসের জন্য আনা প্রতিটি ল্যান্ডক্রুজার গাড়ির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। এর মধ্যে নিলামের বিধি মোতাবেক প্রথমবার নিলামে নির্ধারিত দরের ৬০ শতাংশ কিংবা তার বেশি কাঙ্ক্ষিত দর নির্ধারণ করা হয়। সেই হিসেবে প্রতিটি গাড়ির ন্যূনতম দর ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টম সূত্রে জানা যায়, খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসাইন এবং নীলফামারী-৩ আসনের সাদ্দাম হোসেন পাভেলের আমদানি করা ৩৩৪৬ সিসির ল্যান্ডক্রুজার জেডএস মডেলের গাড়ি দুটি আলাদাভাবে সর্বোচ্চ দর হাঁকেন চট্টগ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ। তিনি ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা করে দর হাঁকেন গাড়ি দুটি কেনার জন্য।
তাছাড়া এস এম কামাল হোসাইনের আমদানি করা গাড়িটির দুই নিলাম দরদাতার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর হাঁকে ভ্যানগার্ড গার্মেন্টস লিমিটেড নামে একটি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ২ কোটি ৭ লাখ ১৫ হাজার টাকায় গাড়িটি কিনতে নিলামে অংশ নেয়।
পাশাপাশি সাদ্দাম হোসেন পাভেলের আমদানি করা গাড়িটির নিলামে আরও দুই প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আড়াই কোটি টাকা দর হাঁকেন ক্রয়লন কওলুন ডিজাইন লিমিটেড নামে একটি রপ্তানিকারী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিশাল আলী।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক আমদানি করেন জাপানের ৩৩৪৬ সিসির ল্যান্ডক্রুজার জেডএস মডেলের আরেকটি গাড়ি। ওই গাড়ির সর্বোচ্চ নিলাম দরদাতা রহিম আফরোজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এস সি আবদুর রহিমের নাতি ফারাজ আব্দুর রহিম। পাঁচজন দরদাতার মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ ২ কোটি ১০ লাখ টাকা দর হাঁকেন।
একই মডেলের একটি গাড়ি আমদানি করেন গাইবান্ধা-২ আসনের শাহ সরোয়ার কবির (স্বতন্ত্র)। তার গাড়িটির সর্বোচ্চ দর ডাকা হয় দেড় কোটি টাকা। সর্বোচ্চ দরদাতা হলো তারাসিমা অ্যাপারেলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজিএমইএর সাবেক নেতা মিরান আলী। মিরান আলী ক্রয়লন কওলুন ডিজাইন লিমিটেডের চেয়ারম্যান মিশাল আলীর ভাই।
একই মডেলের আরেকটি ল্যান্ডক্রুজার জেডএস গাড়ি আমদানি করেন বগুড়া-৫ আসনের মজিবর রহমান মজনু। ওই গাড়ির একমাত্র বিডার হলো ল্যাবএইড লিমিটেড। অনলাইন নিলামে প্রতিষ্ঠানটি ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা দর হাঁকে।
সিরাজগঞ্জ-২ আসনের জান্নাত আরা হেনরীও আমদানি করেন জাপানের একই ল্যান্ডক্রুজার জেডএস মডেলের গাড়ি। কিন্তু ওই গাড়ির সর্বোচ্চ দর ওঠে ৫ লাখ টাকা।
গাজীপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আাকতারুজ্জামান এবং যশোর-২ আসনের মো. তৌহিদুজ্জামানের গাড়ি দুটি কেনার জন্য মহসীন মোহাম্মদ কবীর নামে এক ব্যক্তি মাত্র ১ লাখ টাকা করে দর হাঁকেন।
চট্টগ্রাম কাস্টম সূত্রে জানা যায়, সাবেক এমপিদের বিলাসবহুল ২৪ গাড়িসহ মোট ৪৪ গাড়ি নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টম। গত ২৭ জানুয়ারি সকাল ৯টা থেকে গত রোববার বিকেল ৫টা পর্যন্ত অনলাইনে দরপত্র গ্রহণ করা হয়। নিলামের ৪৪ গাড়িতে মোট দরপত্র পড়ে ১৩৩টি। এছাড়া সাবেক এমপিদের ২৪ গাড়ির মধ্যে দরপত্র পড়ে ১৩টিতে।
তবে শুল্ক সুবিধার বাইরে স্বাভাবিক আমদানি করেও খালাস না নেওয়া ২০টি গাড়ির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০টি দরপত্র পড়েছে ২০১৯ মডেলের টয়োটা এস্কোয়ারের গাড়িটি কেনার জন্য। ২০১৮ মডেলের একটি টয়োটা হ্যারিয়ারে জমা পড়েছে ১৩টি ও ২০২০ মডেলের একটি টয়োটা হ্যারিয়ারে ৯টি দরপত্র জমা পড়েছে।
এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সহকারী কমিশনার (নিলাম) মো. সাকিব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধার গাড়িগুলোতে কাঙ্ক্ষিত দর পাওয়া না গেলেও বেশ কয়েকটি গাড়িতে প্রয়োজনীয় দর উঠেছে। নিলামের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমবার নিলামে নির্ধারিত দরের ৬০ শতাংশ কিংবা তার বেশি দর উঠতে হবে। তবে দ্বিতীয় বারের নিলামে সেই শর্ত নেই। দ্বিতীয়বার নিলামে প্রথমবারের বেশি হলেই কাঙ্ক্ষিত দর হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রথম নিলামে যেসব গাড়ির কাঙ্ক্ষিত ৬০ শতাংশ দর পাওয়া যায়নি, সেগুলো দ্বিতীয় দফা নিলাম ডাকা হবে। হয়তো তখন কাঙ্ক্ষিত বিডার পাওয়া যাবে। সবমিলিয়ে নিলাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।