সরকারি চাকরিতে ক্যাডারগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। পদোন্নতি নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমানোর সুপারিশ করা হবে– এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গতকাল রোববার এই ক্যাডারের কর্মকর্তারা দলবেঁধে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান নেন। তারা তাদের দাবিগুলো সচিবের কাছে তুলে ধরেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে সরব তারা। অন্যদিকে প্রশাসন ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ তাদের দাবি নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার সার্ভিস আছে। এর মধ্যে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ৭৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাকে ২৫ শতাংশ পদোন্নতি দেওয়া হয়।
গত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ও সদস্য মোখলেস উর রহমান বক্তব্য দেন। তারা বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন উপসচিব পুলে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রেখে অন্য ২৫ ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করবে। একই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে সিভিল সার্ভিস থেকে আলাদা করার সুপারিশ সরকারের কাছে করা হবে। উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির বিষয়ে মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা ছাড়া আর কেউ পদোন্নতি পাবেন না। পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা নেবে। ৭০ নম্বর না পেলে পদোন্নতি পাবেন না। প্রতিটি স্তরে (উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত) এটি হবে না। উপসচিব ও যুগ্ম সচিব– এ দুই পর্যায়ে হবে। এর পরের পর্যায়ে সরকার পদোন্নতি দিতে পারবে।
যে পরীক্ষা হবে, সেখানে যদি একজন কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তা সবচেয়ে বেশি নম্বর পান, তিনি তালিকায় এক নম্বরে চলে আসবেন। উপসচিবের তালিকায় তিনি এক নম্বরে আসবেন। মূলত এ বক্তব্যের পরই প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারগুলোর দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে। সেদিনই কমিশনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। প্রশাসনের ক্যাডারের পক্ষ থেকে দেশের ৬৪ জেলার ডিসিও প্রতিবাদ জানিয়ে নিজ নিজ জেলায় কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বক্তব্য রেজুলেশন আকারে কমিশনে পাঠান। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের নিজ নিজ ক্যাডার বিলুপ্তির সুপারিশ করতে যাওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানান।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বক্তব্য– কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এমন সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া বিষয়কে পুনরায় সামনে টেনে আনা হয়েছে। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বক্তব্য– উপসচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের পদ নয়। এ পদগুলো সরকারের। তাই এখানে একটি ক্যাডারকে ৫০ শতাংশ পদ দিয়ে বাকি ২৫ ক্যাডার মিলে ৫০ শতাংশ পদ দেওয়া বৈষম্য। এরই মধ্যে এই বৈষম্যের প্রতিবাদে একগুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে প্রশাসন ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত কলমবিরতি, মানববন্ধন, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে পরিষদ।
উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদ নিয়ে মূল দ্বন্দ্ব
উপসচিব ও এর ওপরের পদগুলো নিয়েই মূলত ক্যাডারগুলোর মধ্য চলছে দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, এটি আসলে নিষ্পত্তি হওয়া বিষয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এটি মীমাংসিত। উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে সব সময়ই প্রশাসন ক্যাডারের লোকেরাই উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব পদে কাজ করে আসছেন। সরকারের নির্বাহী বিভাগের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে মাঠে সহকারী কমিশনার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পলিসি নয়, বরং সব পলিসি বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের মূল কাজটি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই করেন। সচিবালয় আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে একটি যোগসূত্রের মতো কাজ করে। এ কারণেই মাঠ প্রশাসনে কর্মরতরা এ কাজের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। তাই উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদের সবই প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন হওয়া উচিত।
অপরদিকে, প্রশাসন বাদে সিভিল সার্ভিসের অপর ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের নেতা তথ্য ক্যাডারের মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান সমকালকে বলেন, আমরা চাই বৈষম্যহীন, জনবান্ধব ও জনকল্যাণমূলক সিভিল সার্ভিস। আমাদের সুস্পষ্ট দাবি– উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল এবং উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে উপসচিব পদে নিয়োগ দিতে হবে। কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন তথা ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’-এর বাস্তবায়ন চাই। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকেই প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে তৎকালীন অন্য ২৬ (বর্তমানে ২৫) ক্যাডারের বৈষম্য চলে আসছে। এই বৈষম্য নিরসনে একাধিক কমিটি ও কমিশনের সুপারিশ রয়েছে হিমাগারে। অথচ প্রশাসনসহ সব ক্যাডারের কর্মচারী সরকারি কর্মকমিশনের একই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি আরও বলেন, ক্যাডারে ভিন্নতা থাকলেও চাকরির ১০ বছর পূর্ণ হলে যে কোনো ক্যাডারের কর্মচারী উপসচিব পুলভুক্ত হতে পারেন। এই পুলভুক্ত হলে তাদের প্রাথমিক যোগদানের ক্যাডার পরিচিতি থাকে না। সবাই একই ক্যাডারভুক্ত গণকর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন।
সচিবালয়ে শোডাউন, বৈঠক
গতকাল রোববার উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এ ক্যাডারের কর্মকর্তারা দল বেঁধে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান নেন। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্লার নেতৃত্বে তাদের দাবি-দাওয়া সচিবের কাছে তুলে ধরেন। প্রশাসন ক্যাডারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং এ কমিশনের সদস্য সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান রেগুলার সার্ভিসে থাকলে এ ধরনের সুপারিশ করতে যাওয়ার চিন্তাও করতেন না। তারা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিষয়গুলো আর বিবেচনা করছেন না।
এর ফলে এমন সুপারিশ করতে যাচ্ছেন তারা। বেলা সাড়ে ১১টার পর থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিবালয়ের ৩ নম্বর ভবনের সামনে জড়ো হন। ঢাকার মধ্যে যে কর্মকর্তাদের অফিস, তাদের অনেকেই সচিবালয়ে চলে আসেন। জনপ্রশাসন সচিবের কক্ষের সামনে তারা প্রথমে অবস্থান নেন, পরে তারা সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। বৈঠকে বিএএসএর পক্ষ থেকে কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা ‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’ এমন অভিযোগ জানিয়ে স্মারকলিপি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে হস্তান্তর করেন। গতকাল সকাল থেকেই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের দাবি সম্মিলিতভাবে ফেসবুকে প্রচার করেন। তারা এ সময় বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারকে আলাদা করে ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠার দাবিতেও সরব হন।
সিনিয়র সচিব যা বললেন
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনায় বসা হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। তিনি বলেন, ‘আশা করছি এ আলোচনার পর বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে আর ভুল বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ থাকবে না। এটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংস্কার কমিশনের চলমান প্রক্রিয়া। এটা যেহেতু একটা পর্যায়ে এসেছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের যারা স্টেকহোল্ডার আছে তাদের মতামত আছে তারা দিচ্ছেন।
অনেকে অনলাইনে দিচ্ছেন, কেউ লিখিত দিচ্ছেন। আজ প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা লিখিত দিয়েছেন। এটা আমরা সংস্কার কমিশনে দেব।’ সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শোডাউন করতে পারেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা) হলো একটা সংগঠন। তারা এখানে এসেছেন, তারা হয়তো দলবেঁধে এসেছেন। এ বিষয়ে পজিটিভলি এগোনো উচিত।
এ বিষয়ে বাসার সভাপতি মো. আনোয়ার উল্লাহ বলেন, তারা কমিশনের সদস্য সচিবের মুখ থেকে একটা কথা শোনার জন্য ১০ মিনিটের জন্য এসেছেন। তারা আসতেই পারেন। এখানে কোনো অশোভন আচরণ করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘এটা একটি শোভনীয় প্রক্রিয়া। আমরা স্যারের মুখ থেকে কিছু কথা শোনার জন্য এসেছি। আমরা যেহেতু কমিশনপ্রধানকে পাচ্ছি না, স্যারকে পেয়েছি; তাই আমরা আমাদের একটা কাগজ হস্তান্তরের জন্য এসেছি। এটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।’
সচিবালয়ে দুই হাজার কর্মকর্তা এসেছেন, বাইরে থেকেও কর্মকর্তারা এসেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল) সমন্বয়ক সভা ছিল। সে জন্য জেলা থেকে কমিটির লোকজন এসেছেন। সচিবালয়ে সহকারী সচিব পর্যায়ে হিসাব করুন। আমার মনে হয় না, ১৫০ জন লোক এসেছেন। আমাদের বাসার সদস্য হচ্ছেন ৫১ জন।’
কলমবিরতি কর্মসূচি
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আগামীকাল মঙ্গলবার দেশের সব অফিসে এক ঘণ্টা কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করবেন ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে উপসচিব পদে মেধার ভিত্তিতে শতভাগ পদোন্নতি এবং পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অন্যদিকে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমানো হলে আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।