সচিবালয়ে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর বকশিবাজারে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে। ২০০৯ সালে বিডিআর পিলখানায় সংঘটিত বর্বরতম হত্যাকা-ের বিচার চলছিল আদালতটিতে। ওই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া মামলায় দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি থাকা ৮৩৪ বিডিআর জওয়ানের জামিন শুনানির কথা ছিল গতকাল (বৃহস্পতিবার)। বুধবার রাতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে এই মর্মে সার্কুলার জারির পরপরই ঘটে অগ্নিকা-। এর ফলে আবারো হোঁচট খেলো বন্দিদের জামিন শুনানি। আপাতত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বন্দিদের মুক্তি লাভ।
ঘটনার পর পুলিশ জানায়, আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতের একটি কক্ষে আগুন দেয়া হয়েছে। মাদরাসার বাইরে একটি গাড়ি অবস্থান করলেও প্রধান দুটি ফটক ছিল তালাবদ্ধ। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস তাই কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। বৃহস্পতিবার ভোরে অন্ধকারেÑ এ ঘটনা ঘটে-মর্মে দাবি করেছে চকবাজার থানা পুলিশ। সচিবালয়ের পরপরই রাতে আদালতে আগুন দেয়ার ঘটনা নাশকতা কি-না এমন প্রশ্নে পুলিশ বলছে, তদন্ত চলছে। এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। গত কয়েক দিন ধরেই বিডিআর পিলখানা হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত বিস্ফোরক আইনের মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি ৮৩৪ জন বিডিআর জওয়ানের মুক্তি দাবি জানিয়ে আসছেন বন্দিদের স্বজনরা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একাধিকবার বলেছে, দ্রুত শুনানি করে নিরপরাধ বন্দিদের মুক্তির উদ্যোগ নেবে।
কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় আন্দোলনে নামেন বন্দিদের স্বজনরা। গত মঙ্গলবার তারা রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান ধর্মঘট করেন। বুধবার রাতে তারা অবস্থান নেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ‘নিরপরাধ বন্দি’দের মুক্তিসহ তিন দফা দাবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার শাহবাগে অবস্থান নেন। দিনের বেলা রাস্তা অবরোধ করেন। ওই দিন রাতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সার্কুলার জারি করে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার সকালে বকশিবাজারস্থ ঢাকা আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতেই হবে বিস্ফোরক মামলায় কারাদ-প্রাপ্তদের জামিন শুনানি। কিন্তু ওই রাতেই রহস্যজনক আগুনে পুড়ে যায় অস্থায়ী আদালত। আগুনে পুরো এজলাস কক্ষ পুড়ে যায়। তবে কীভাবে ওই আগুনের সূত্রপাত ঘটে তা জানা যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা রোজিনা আক্তার জানান, রাত ৩টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এ সময় আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে তারা আগুন নেভাতে পারেননি।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, আগুনে আদালতের এজলাস কক্ষটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। এজলাস কক্ষের ভেতরে এসিসহ যাবতীয় আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আদালতের সবকটি কক্ষের গ্লাস ভাঙচুর করা হয়েছে। আদালতে আগুন লাগার খবর পেলে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারক এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই আদালতে কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয় মর্মে-প্রসিকিউশন টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়। সরকারপক্ষের প্রধান আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিন ও আসামিপক্ষের আইনজীবী পারভেজ হোসেন এজলাস কক্ষ পরিদর্শন শেষে জানান, এজলাস কক্ষ পরিদর্শন শেষে বিচারক বৃহস্পতিবারের মতো আদালতের কার্যক্রম মুলতবি ঘোষণা করেছেন। পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন ১৯ জানুয়ারি। এর আগে আলিয়া মাদরাসা মাঠ থেকে অস্থায়ী আদালত সরিয়ে নেয়ার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন ছাত্ররা। তারা মাদরাসা মাঠ থেকে অস্থায়ী আদালত সরিয়ে নেয়ার দাবিতে গতকাল প্রায় ১০ ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে রাখেন।
কর্তৃপক্ষের আশ্বাস পেয়ে পরে তারা অবরোধ তুলে নেন। এদিকে বুধবার রাতের আগুন ছাত্রদের পক্ষ থেকেই লাগানো হয়েছে কি-না, এমন প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্ররা অভিযোগ অস্বীকার করেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে ওমর ফারুক বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে এই প্রশ্নে আদালত আলিয়া মাদরাসা মাঠ থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবি করে আসছিলাম। মাঠ থেকে আদালত সরিয়ে নেয়া হবেÑ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বিচারক এসে পরিস্থিতি দেখে গেছেন। তিনি বলেছেন, এখানে বিচারকার্য চালানোর মতো অবস্থা নেই।
আবির নামের আরেক শিক্ষার্থী জানান, দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের মাঠ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন দিয়েছি। কিন্তু মাঠ হস্তান্তরে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। আমরা আশা করেছিলাম এই সরকার ছাত্র-জনতার সরকার আমাদের দাবি খুব দ্রুত মেনে নেবে। কিন্তু তারা আমাদের হতাশ করেছে। এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, আদালতের কক্ষে আগুন লাগার বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কিছুই জানে না। রাতে মাঠের গেটে তালা লাগানো ছিল। আমরা অবস্থান করছিলাম সড়কে। এর মধ্যে বুধবার মধ্যরাতে দুজন লোক এসে তালা কেটে দিয়ে দ্রুত চলে যায়।
কায়সার উদ্দিন নামের আরেক মাদরাসা শিক্ষার্থী বলেন, অন্য কোনো মহল থেকে আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে। শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই জড়িত নয়। কারা কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে মাঠটি দখল করে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে আদালত পরিচালনা করছে। ছাত্ররা মাঠটির দখলমুক্ত করতে চায়। কারণ এই মাঠ শিক্ষার্থীদের। আরেক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে জানান, ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের আগুন নেভাতে সহায়তা করা হয়েছে। আগুন দেয়ার ঘটনার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য আগুন লাগানো হতে পারে বলে ধারণা শিক্ষার্থীদের।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার তদন্তে কাজ করছে পুলিশ। নাশকতা কি-না তদন্তের আগে বলা যাচ্ছে না। বিডিআর হত্যাকা-ের বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের হওয়া মামলাটির বিচার কার্যক্রম গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারস্থ আদালতে নাকি আলিয়া মাদরাসা মাঠের আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু হবেÑ এমন বিভ্রান্তি দেখা দেয় বুধবার। পরে ওই রাতে আইন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার সকালে বকশিবাজারস্থ আলিয়া মাদরাসা মাঠেই বসবে আদালত। এমন সিদ্ধান্তের পরপরই ঘটে অগ্নিকা-ের ঘটনা।
এদিকে আলিয়া মাদরাসা মাঠে কিংবা কেরানীগঞ্জস্থ কারাগার সংলগ্ন অস্থায়ী আদালতের কোনোটিতে কারাবন্দিদের জামিন শুনানি গতকাল পর্যন্ত শুরু না হওয়ার ঘটনাকে ‘ষ’ড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন চাকরিচ্যুত বিডিআর জওয়ানরা। গতকাল সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করে বিডিআরের চাকরিচ্যুত জওয়ানরা বলেন, পিলখানা হত্যা মামলার বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রহসন চলছে। সব মিথ্যা মামলা বাতিল ও কারাবন্দি সদস্যদের মুক্তির দাবি জানান তারা। কেরানীগঞ্জে আদালত বসার কথা থাকলেও সেটি না হওয়ায় একে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন তারা। বিডিআর সদস্যরা দেশবিরোধী চক্রান্তের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে তারা বলেন, কারাবন্দিদের মুক্তিসহ তিন দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে।
কারাবন্দি বিডিআর জওয়ানদের জামিন শুনানিতে সাময়িক অনিশ্চয়তায় উদ্বেগ জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির ইনকিলাবকে বলেন, পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকা-ের পর হ’ত্যা মামলায় আদালত রায় দিয়েছেন। হ’ত্যা মামলার রায়ে যাদের পাঁচ বছর বা সাত বছরের সাজা হয়েছে, তারাও বিস্ফোরক মামলার আসামি হওয়ায় গত ১৬ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। তাদেরও অধিকার রয়েছে জামিনে বেরিয়ে এসে আইনি মোকাবিলা করা। দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে যারা কোনো অপরাধ করেনি তাদের মুক্তি দেয়া উচিত।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বস্ত হয়েছি, আদালতের রায়ের পর অন্যায়ভাবে সরকার আদালতের উপর হস্তক্ষেপ করবে না। যা গত ১৬ বছর পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় করা হয়েছে। আমরা দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে নিরপরাধ বিডিআর জওয়ানদের মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। যারা অস্থায়ী আদালত পুড়িয়ে দিয়েছে তাদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর পিলখানায় নারকীয় হত্যাকা- সংঘটিত হয়। ওই ঘটনায় নিহত হন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। এ ঘটনাকে নিছক ‘বিদ্রোহ’র ঘটনা বলে চিহ্নিত করে তৎকালিন আ.লীগ সরকার। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। দুই কমিটির প্রতিবেদনে ‘বিডিআর বিদ্রোহ’র ঘটনার বিচার সেনা আইনে করার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের মতামতের ভিত্তিতে আ.লীগ সরকার প্রচলিত আইনেই বিচারের উদ্যোগ নেয়। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দুটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। একটি ছিল হ’ত্যা মামলা আর অন্যটি বিস্ফোরক আইনের মামলা।
হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের ‘বিচার’ সম্পন্ন হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। এতে ১৫২ জনের মৃত্যুদ-, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়। বেকসুর খালাস দেয়া হয় ২৭৮ জনকে। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর এ মামলায় হাইকোর্টে আপিলের রায়ও হয়ে যায়। অপরদিকে বিস্ফোরক মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিচার ঝুলে যায়। অথচ এই মামলাটি হ’ত্যা মামলার সঙ্গেই ২০১০ সালে বিচার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে শুধু হ’ত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে শেখ হাসিনার সরকার। বিস্ফোরক আইনের মামলায় কোনো সাক্ষ্যই উপস্থাপন করেনি। একপর্যায়ে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম বন্ধই হয়ে যায়।
২০২০ সালে করোনার অজুহাতে আর বসেনি বিশেষ আদালত। ফলে কারাবন্দি রয়ে যান মামলায় অভিযুক্ত বিডিআর জওয়ানরা। হ’ত্যা মামলায় যাদের মৃ’ত্যুদ- কিংবা যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে তারা দ-াদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। সেই আপিল এখনো শুনানির অপেক্ষায়। অন্যদিকে বিদ্রোহের মামলায় যারা বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ে দ-িত হয়েছেনÑ এরই মধ্যে তাদের কারাভোগ শেষ। এছাড়া যারা বেকসুর খালাস পেয়েছেন তাদের অনেকে বিস্ফোরক মামলারও আসামি। ফলে সাজা খাটা শেষ হওয়া এবং বেকসুর খালাস পাওয়া নিরপরাধ অন্তত ৮৩৪ বিডিআর জওয়ান এখনো কারাবন্দি রয়েছে। নানা অজুহাত দেখিয়ে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি ঝুলিয়ে রাখে হাসিনার সরকার। আ.লীগ সরকার উৎখাত হওয়ার পর দাবি ওঠে এই নিরপরাধ বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার।